“রাষ্ট্রের দায়িত্ব জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষা করা। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।”
Published : 08 Sep 2022, 08:54 PM
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হামলা এবং নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার বিচার দাবি করে এসব ঘটনায় সরকার ও পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।
তিনি বলেছেন, “আদিবাসীদের উপর নির্যাতন হত্যা, ভূমি দখল চলতেই থাকবে? এটা তো হতে পারে না। তারা কি আন্দোলন করতে করতেই জীবন পার করবে?
“রাষ্ট্রের দায়িত্ব জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষা করা। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে নয়টি আদিবাসী ও নাগরিক সংগঠনের যৌথ আয়োজনে ‘সাতক্ষীরার নরেন্দ্র মুন্ডা হত্যা ও আদিবাসী ভূমি দখলের প্রতিবাদে’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা উন্নয়ন চাই। যদি উন্নয়নের সুফল সব জনগোষ্ঠী সমানভাবে না পায়, তাহলে সেটি কিসের উন্নয়ন? দেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কারণে এসব নির্যাতনের শিকার মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।”
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “পুলিশি ভূমিকার নিন্দা জানাতে জানাতে আমরা ক্লান্ত। আমরা চাই, পুলিশ নিজেদের দিকে ফিরে তাকাক। কেন সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইতে হবে?”
সরকারের সমালোচনা করে সুলতানা কামাল বলেন, “ক্ষমতা পেতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বলে দাবি করলেও তারা চেতনার বাইরে গিয়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপসের নীতি অনুসরণ করছে।
“নারীর সমতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও পাঠ্যপুস্তকে সাম্য নীতি থেকে সরকার সরে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে, কিন্তু তারা সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে।”
শ্যামনগরের মুন্ডা পল্লিতে ‘হামলা’, জমি দখলের অভিযোগ
‘জমি দখলে বাধার সময়’ হামলায় আহত নরেন্দ্র মুন্ডা মারা গেছেন
শ্যামনগরের হামলা ও নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার বিচার দাবি করে সুলতানা কামাল বলেন, “মানুষের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলন নরেন্দ্র মুন্ডার ভাতিজা এবং হত্যা মামলার বাদী ফনিন্দ্রনাথ বলেন, “গত ১৯ অগাস্ট জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী মহলের হামলায় ১২ জন মুন্ডা আদিবাসী আহত হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার চাচা নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা মারা যান। জমিটি নিয়ে মামলা চলছে। আমরা বলেছিলাম, কোর্টের রায় যা হবে তা মেনে নেব, তার আগে কিছু নয়।
“কিন্তু তারা সেটা মেনে না নিয়ে মারধর করে এবং ফসল নষ্ট করে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেউ হামলার পর এগিয়ে আসেনি। ৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ আমাদের উদ্ধার করে।”
তিনি বলেন, “হত্যা মামলার চার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রধান আসামি রাশিদুল ও এবাদুলকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমরা হামলার পর থেকে আতংকিত অবস্থায় আছি। আমরা অতি দ্রুত এদের বিচার দাবি করি।”
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর নয়। স্থানীয় জনগণ বলছে, পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক।”
সংবাদ সম্মেলনে ৯টি দাবি তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, আহত মুন্ডা নারী রিনা মুন্ডা, মুন্ডাদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আশিক-ই-এলাহী উপস্থিত ছিলেন।ৎ
পার্বত্য ভূমি কমিশনের সভা স্থগিতে উদ্বেগ
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিত করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ২৩ জন নাগরিক।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ভূমি কমিশনের সভা স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান তারা। ২৩ জনের পক্ষে তাদের স্বাক্ষরিত বিবৃতিটি পাঠান এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
বিবৃতিতে বলা হয়, “পার্বত্য চুক্তির পর ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও গত ২১ বছরে কমিশন একটি ভূমি-বিরোধেরও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। তবে ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।”
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ নামে চুক্তিবিরোধী পক্ষ এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে অভিযোগ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “এটাও লক্ষণীয়, সরকারের ভেতরের একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল প্রচ্ছন্নভাবে, কখনও কখনও প্রকাশ্যে এই চুক্তি বিরোধীদের সহিংস ও ধংসাত্মক তৎপরতায় ইন্ধন যুগিয়ে আসছে। তাদেরই মদদে এই কথিত নাগারিক পরিষদ সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা বাতিলের জন্য ৩২ ঘণ্টা ধর্মঘট ঘোষণা করে এবং হরতালের নামে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালায়। আর এই উছিলায় ৭ সেপ্টেম্বর পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা স্থগিত করা হয়।”
বিবৃতিদাতারা হলেন- মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ও হামিদা হোসেন, নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, আদিবাসী অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না, রিব’র নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তবারক হোসেন, সারা হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন কণা ও এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।