প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব যেমন দেখা হচ্ছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানোর কথাও আসছে।
Published : 14 Nov 2022, 11:28 PM
মাধ্যমিকে প্রশ্ন ফাঁস ও ভুল প্রশ্ন বিতরণের সমালোচনার পর এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার তিনটি প্রশ্ন নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
পরীক্ষার প্রথম দিন ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ ওঠে। এই প্রশ্নের প্রণয়ন ও মডারেশনে থাকা পাঁচ শিক্ষকের বিষয়ে তদন্ত করছে যশোর শিক্ষা বোর্ড।
একই দিন কারিগরি বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষার বাংলা-২ প্রশ্নপত্রে একজন লেখককে হেয় করার বিষয়েও তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এই প্রশ্নে একটি নারী চরিত্রকেও হেয় করার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া প্রশ্নে সিলেবাস গুলিয়ে ফেলায় কারিগরি বোর্ডের এইচএসসির (বিএমটি) বাংলা-১ পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে স্থগিত করতে হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নে প্রতি বছরই ভুলের অভিযোগ আসছে। এ বছর ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় সামনে আসায় প্রশ্ন প্রস্তুতকারী শিক্ষকদের মানসিকতা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্ন নিয়ে এবার যা হয়েছে, তাকে উদ্বেগজনক বলছেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার।
এজন্য প্রশ্ন প্রণয়নকারীর পাশপাশি মডারেটরদের দায় দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা মূল পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি যে, কিছু জায়গায় বানান ভুল ছিল, মডারেটররা লাল কালি দিয়ে সেটা ঠিক করেছেন। তার মানে তারা এটা পড়েছেন, এটাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন।”
এইচএসসির প্রশ্নে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’: তদন্ত কমিটিতে ৫ শিক্ষকের বক্তব্য
এইচএসসির ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন’ অবহেলায় না ইচ্ছাকৃত, তদন্ত হচ্ছে: শিক্ষামন্ত্রী
লেখক আনিসুল হককে নিয়ে প্রশ্নকারী ও মডারেটর চিহ্নিত
গলদ কোথায়?
পাবলিক পরীক্ষায় বোর্ডগুলো প্রতি বিষয়ে চার সেট প্রশ্ন সিলগালা করে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডে পাঠায়। নয়টি বোর্ডের ৩৬ সেট প্রশ্ন থেকে লটারির মাধ্যমে প্রতি বোর্ডের জন্য দুটি প্রশ্নপত্র ঠিক করে মুদ্রণের জন্য পাঠানো হয়।
বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস এড়াতে পরীক্ষার আগে তা দেখার সুযোগ নেই। প্রশ্নের মান ও সেটি নির্ভুল রাখতে প্রশ্ন প্রণয়নকারী এবং মডারেটরদের উপরই নির্ভর করতে হয়। তবে তাদের সংবেদনশীল বিষয় প্রশ্নে না রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, প্রশ্ন তৈরিতে গোপনীয়তার যে নীতি অনুসরণ করা হয়, তাতেই গলদ থেকে যাচ্ছে।
“এই গলদটা ব্যক্তি পর্যায়ের। ওই ব্যক্তির মন-মানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা প্রশ্নে চলে আসে। সেটা থেকেও যায়, কারণ কেউ দেখতে পারে না। যারা প্রশ্ন করছেন, পরে যারা মডারেশন করছেন, তাদের মাইন্ডসেট, অদক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি কাজ করে।”
বিতর্কিত বিষয় এড়াতে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষা বোর্ডগুলোকে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটর নিয়োগে আরও সতর্ক হতে বলেছেন।
বোর্ডগুলো প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটর নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট-বেডুর প্রশিক্ষণে তৈরি ‘মাস্টার ট্রেইনার’ তালিকা থেকে।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক তোফাজ্জুর রহমান বলছেন, প্রশ্নের সৃজনশীল অংশের জন্য চারটি সেটে ৪ জন, নৈব্যক্তিক অংশের জন্য ২ জন- অর্থাৎ ৬ জন প্রশ্ন করেন। সেটি মডারেশন করেন ৪ জন।
কিন্তু এই ১০ জন ‘মাস্টার ট্রেইনার’ পাওয়াই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
“তখন আমরা মাস্টার ট্রেইনার না হলেও যারা ভাল শিক্ষক তাদের থেকে দু-একজনকে নেই। আমরা শিক্ষকই পাই না। গত বছর বোটানির পরীক্ষায় আমি পেলাম ৭জন। তখন বাকি ৩ জন ভাল শিক্ষক আমি নির্বাচন করেছি।”
তার মতে, স্বজনপ্রীতি বা অন্য কোনো কারণে এই বাছাই প্রক্রিয়ায় ভুল হয়।
“এখানে আমাদের যে কোনো দায়ভার নেই, তা কিন্তু নয়। বোর্ডে যারা আছেন, তারাই তো প্রশ্ন প্রণেতাকে দায়িত্ব দেবেন। এক্ষেত্রে যার ওপর আস্থা আছে, তাকে এ দায়িত্ব দিতে হবে।”
‘মাস্টার ট্রেইনার’ সংকটের কারণ ব্যাখ্যা করে তোফাজ্জুর বলেন, “বেডু কলেজ শিক্ষকদের ২০১২-১৩ সালে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাতে যারা ৫০ এর ওপরে স্কোর পেয়েছেন, তাদের মাস্টার ট্রেইনার বলা হয়। তারাই প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন ও প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পাচ্ছেন। ট্রেনিংয়ের অনেকেই এখন অবসরে চলে গেছেন।”
গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যাদের শিক্ষকতায় থাকা উচিৎ না। অনেক সময় চাপে ভুল লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়। চাপমুক্ত হয়ে সঠিক লোককে নিয়োগ দেওয়া গেলে এগুলোর সমাধান হবে।
“অনেক শিক্ষক আছেন, যারা নিয়মের বাইরে যাবেন না; আবার অনেক সময় ওপর মহলের চাপে অনেক শিক্ষককে দায়িত্ব দিতে হয়। আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে ভালো শিক্ষক বাছাই করতে হবে।”
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলছেন, শুধু মাধ্যমিক পর্যায়েই ৪ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক রয়েছেন, তাদের ‘মনিটরিং’ করা কঠিন।
তার মতে, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করা খুব কঠিন হওয়ায় অনেকে হিমশিম খান। এক্ষেত্রে তিন-চার দিনের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট না।
“যেই তিনটা প্রশ্ন নিয়ে আমরা সমালোচনা করছি, সেগুলোর কাঠামো বা প্রশ্নের গঠন- ইত্যাদি টেকনিক্যাল দিক নিয়ে আমরা প্রশ্ন করছি না। আমরা প্রশ্ন করছি বিষয়টা নিয়ে। ট্রেইনিংয়ে তো বিষয়টা শেখানো হয় না। টেকনিক্যাল দিকগুলোর ওপরই জোর দেওয়া হয়।”
গোলাম ফারুকের দাবি, যারা ভাল সৃজনশীল প্রশ্ন করতে জানেন, তারাই দায়িত্ব পান। ঢাকার প্রশ্ন প্রণয়নকারী ২২ বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষক প্রশান্ত কুমার পালের দক্ষতারও অভাব দেখছেন না তিনি।
“মূল সমস্যাটা হচ্ছে- দৃষ্টিভঙ্গী, অবহেলা। কাউকে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না, এ জ্ঞানটা সেই শিক্ষকের নেই বলেই এ ধরনের প্রশ্ন করেছেন। এটা শিক্ষককে শেখানোর বিষয় না, বরং তিনিই তা সবাইকে শেখাবেন।
“যে শিক্ষকরা এই কাজগুলো করেছেন, তাদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া হলে অন্য শিক্ষকরাও সাবধান হয়ে যাবেন।”
নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের গুরুত্ব বাড়লে কোনো শিক্ষক ভুল করলেও তার প্রভাব বড় আকারে পড়বে না বলে আশা করছেন গোলাম ফারুক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান মনে করেন, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে শিক্ষকের যথাযথ দক্ষতা না থাকলে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে। সেজন্য আরও কার্যকর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
“প্রশিক্ষণদাতাদের আরও সতর্ক হতে হবে যে, যারা ট্রেইনিং পাচ্ছে, তারা বিষয়গুলো বুঝছে কিনা। যারা সিলেকশন করছে, তাদেরও দেখতে হবে যাকে নির্বাচন করা হল, তিনি যথাযথ লোক কি না? এরপর মডারেশন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হল কি না? সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।
“যাকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার পেশাগত দায়বদ্ধতা কেমন, কমিটমেন্ট কেমন- সেটা দেখেও তাকে নির্বাচন করতে হবে।”
৪ জন মডারেটর একটি প্রশ্ন মডারেশনে ১০ দিন সময় পান। এরপরও বিতর্কিত প্রশ্ন তৈরির পিছনে দায়িত্বে অবহেলা দেখছেন দিনাজপুর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তোফাজ্জুর রহমান।
“তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এগুলো চলতেই থাকবে,” বলেন তিনি।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকারও বলছেন, শিক্ষকদের আরও সচেতন করতে হবে।
তবে যেসব ভুল হচ্ছে তা প্রশিক্ষণ দিয়ে ঠিক করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যিনি প্রশ্নটা করেছেন, তার মাইন্ড সেটআপই ওরকম। এখন এসব প্রশ্ন প্রণেতা ও মডারেটরদের চিহ্নিত করতে হবে যে, কারা এসব বিতর্কিত প্রশ্ন করে। তাদের শাস্তির আওতায় আনলে পরে অন্যান্য শিক্ষক সতর্ক থাকবেন প্রশ্ন করার বিষয়ে। তখন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।”