বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর সাফ জবাব, “আইন তার নিজের গতিতে চলবে।”
Published : 29 Aug 2023, 06:55 PM
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার আসামি নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে যারা বিবৃতি দিচ্ছেন, তাদের বিবৃতি না দিয়ে বিশেষজ্ঞ আইনবিদ পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাতে তারা দেখতে পারেন, এখানে কোনো অন্যায় হয়েছে কি না।
তিনি বলেছেন, “আমার খুব অবাক লাগছে, ভদ্রলোকের যদি এতই আত্মবিশ্বাস থাকত, যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না।”
শ্রম আদালতে ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম এগিয়ে চলার প্রেক্ষাপটে ১০০ নোবেল বিজয়ী এবং বিভিন্ন দেশের ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে ইউনূস ‘কারারুদ্ধ হতে পারেন’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে ‘হয়রানি’ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সিভিক কারেজ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সোমবার ওই বিবৃতি আসে। ‘প্রটেক্ট ইউনূস’ নামে একটি প্রচারাভিযানও শুরু করেছে সংগঠনটি।
ব্রিকস সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানাতে প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এলে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে সেখানে ইউনূসকে নিয়ে বিবৃতির বিষয়টিও আসে।
একজন সাংবাদিক জানতে চান, ওই বিবৃতির প্রেক্ষাপটে সরকার কোনো নমনীয়তা দেখাবে কি না। ওই বিবৃতির কারণে বিচারে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তাও জানতে চান আরেক সাংবাদিক।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাছাড়া আমাদের দেশে সবকিছু একটা আইনমত চলে। কেউ যদি ট্যাক্স না দেয়, আর যদি শ্রমিকের অর্থ আত্মসাত করে, আর শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শ্রম আদালতে যদি মামলা করা হয়, সেখানে আমাদের কি হাত আছে? আমরা মামলা বন্ধ করে দেব? আপনারাই বিচার করেন।”
সরকার যে শ্রম আদালতের ওই মামলা করেনি, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটা চলমান মামলা, আমাদের দেশে তো চলমান মামলা নিয়ে আলোচনাও করি না। কারণ এটা বিচারাধীন। যেখানে বিচারাধীন হিসেবে নিজের দেশেই কথা বলা বন্ধ করা হয়। সেখানে বাইরে দেশ থেকে বিবৃতি এনে মামলা প্রত্যাহারের কথা, আমি কে মামলা প্রত্যাহারের? এখানে আমার কোন অধিকারটা আছে, সেই অধিকারটা দিয়েছেন আমাকে? জুডিশিয়ারি তো সম্পূর্ণ স্বাধীন।
“একটা দেশে জুডিশিয়ারি, লেজিসলেটিভ এবং এক্সিকিউটিভ তিনটা অঙ্গ একসঙ্গে চলে। কিন্তু একটা আরেকটার প্রতি হস্তক্ষেপ আমরা করতে পারি না।”
ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি না দিয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী পাঠানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা এই বিবৃতি দিয়েছেন, তাদেরকে আমি আহ্বান করি, তারা এক্সপার্ট পাঠাক। তাদের যদি এত দরদ থাকে তারা আইনজীবী পাঠাক এবং যার বিরুদ্ধে মামলা তার সমস্ত দলিল দস্তবেজ খতিয়ে দেখুক। তারাই এসে দেখুক কোনো অন্যায় আছে কি না।
“বিবৃতি দিয়ে কীভাবে একটা মামলা তোলে, তা তো আমরা জানি না। কিন্তু তাদের এসে দেখা দরকার এখানে কি কি অসঙ্গতি আছে, অসম্ঞ্জস্যতা আছে।”
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টাকে ‘শান্তি স্থাপন’ বিবেচনা করে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে।
১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনা হওয়ার পর থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ইউনূস। বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে তাকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে হেরে যান ইউনূস।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করার অভিযোগে একটি মামলায় গত জুন মাসে ইউনূসের বিচার শুরু করে শ্রম আদালত।
সর্বশেষ সোমবার গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন কর্মচারী তাদের পাওনা মুনাফা না দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেন, সেখানে কোম্পানির চেয়ারম্যান ইউনূসকে আসামি করা হয়।
ইউনূসের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে দুইশর মত মামলা রয়েছে বলে তার আইনজীবী আবদুল্লাহ-আল-মামুন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
সিভিক কারেজের ব্যানারে নোবেলজয়ীদের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে এবং মনে হয়, আগামী নির্বাচনের আগেই ড. ইউনূসকে কারারুদ্ধ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।”
ইউনূসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো ‘আইনি সারবত্তা নেই’ এবং ‘আইনি প্রক্রিয়ারও ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করা হয় সেখানে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “শ্রমিকদের জন্য তো আমাদের অনেক কথা শুনতে হয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বে শুধু নালিশ আর নালিশ। এই দেশের কোম্পানি আইনে আছে, প্রফিটের শতকরা পাঁচ ভাগ লেবার ওয়েল ফেয়ারে দিতে হবে। এখন যদি কেউ না দেয়, লেবাররা মামলা করে, মামলা করার ফলে তাদের ছাঁটাই করা হয়, তারা যদি আবার মামলা করে, সে দায়িত্ব তো আমাদের না।
“আবার এই মামলা যাতে না হয়, তার জন্য ঘুষ দেওয়া হয়। সেই ঘুষের টাকা পর্যন্ত যাওয়া, সেই নেতারা যে ঘুষ খেয়েছে সেই টাকা ব্যাংকে ফ্রিজ করা।… যারা বিবৃতি দিয়েছে তাদের আহ্বান জানাই, বিবৃতিটা না দিয়ে তার এক্সপার্ট পাঠাক, তাদের ক্লায়েন্টের জন্য, আইনজীবী পাঠাক এবং তারা এসে দলিল দস্তাবেজ কাগজপত্র সব দেখুক যে সেখানে কোনো অন্যায় আছে, না তাকে অন্যায়ভাবে কোনো মামলা দেওয়া হয়েছে।”
পৃথিবীর কোনো দেশে কর ফাঁকি দিলে ছাড় দেওয়া হয় না মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে ট্যাক্স ফাঁকিতে যদি কেউ ধরা পড়ে, তাকে তো সেই ট্যাক্স ফেরত দিতে হবে, কিছু কিছু ফেরত দিয়েছেও। এনবিআর থেকে যেটা বলা হয়েছে,পাঁচ হাজার কোটিই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেগুলো স্থগিত হয়ে আছে।
“স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক একটা চাপ, যেখানে সরকারের অর্থ পাওনা, সেখান থেকে তো অর্থ আদায় করতেই হবে। যারা ট্যাক্স দেয় না এনবিআর তাদের অর্থ ছাড়বে কেন। ট্যাক্স দেওয়া তো সকল নাগরিকের দায়িত্ব। যদি আপনার বিদেশে, আমেরিকা বলেন ইংল্যান্ড বলেন, ইউরোপ বলেন, কেউ যদি তাদের দেশের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, তাদেরকে কি কোলে তুলে নাচে তাদের সরকার? না তাদের মামলা দেয়।”
বিশ্বে ‘বহু নোবেলজয়ীকে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য জেলে যেতে হয়েছে’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলে, “ফিলিপাইনের নোবেলজয়ী, তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার মামলায় দিনের পর দিন, সেই মামলা তাকে চালাতে হয়েছে। এইরকম বহু নোবেলজয়ী আছে, তারা কারাগারে বন্দিও আছে পরবর্তীতে অনেক কাজের জন্য। এখন একজনের জন্য এত এত বিবৃতি না দিয়ে তারা একটা এক্সপার্ট পাঠিয়ে দেখুক।”
বিশেষজ্ঞা পাঠালে ‘আরও অনেক কিছু’ বেরিয়ে আসতে পারে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি মনে করি তারা যদি একবার পাঠায় তাহলে, আরও অনেক কিছু বের হবে, যেটা আমরা হাতই দিইনি। এমন অনেক কিছু বের হবে। সেটা করা দরকার, বিবৃতি না দিয়ে আসেন, এক্সপার্ট পাঠান এবং সবকিছু যাচাই করে দেখেন সেই আহ্বান জানাই।”
ইউনূস ছিলেন সরকারি মালিকানার একটি ব্যাংকের এমডি, সেই পদে থেকে তিনি কী করে বিদেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করলেন, সেই প্রশ্নও তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “সরকারি বেতনভোগী একজন এমডি বিদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কীভাবে ইনভেষ্ট করে? বাণিজ্য করে? এই যে শত ইন্টেলেকচুয়াল যারা বিবৃতি দিলেন, তারা কি জিজ্ঞাসা করেছেন, একটি ব্যাংকে চাকরি করা অবস্থায় কীভাবে বিদেশে এত টাকা বিনিয়োগ করলেন। ব্যবসা করলেন, আসা যাওয়া করেন, এত কিছু করেন কোনো নিয়ম নাই।”
কোথা থেকে টাকাটা এল, কীভাবে টাকাটা উপার্জন করা হল, সে কথা সাংবাদিকরা কখনো ইউনূসকে জিজ্ঞাসা করেছেন কিনা, সেই প্রশ্নও তোলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমাদের একজন রাজনীতিবিদ করলে লিখতে লিখতে কলম শেষ হয়ে যেত। দুর্নীতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, দুর্নীতিবাজ পছন্দ না হলে কোনো দোষ নাই, আর পছন্দ হলে তারে ভালো করে আচ্ছা মত, এটা অবস্থান অপনাদের?”
বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশে তিনি আবারও বলেন, “তারা এক্সপার্ট পাঠাবে, সমস্ত দলিল দস্তাবেজ দেখবেন এবং তারাই বিচার করে যাক এখানে কোনো অপরাধ আছে কি নাই। আর নয়ত আমাদের দেশে আইন আছে, আদালত আছে, শ্রম আইন আছে, শ্রম কোর্ট আছে। আইন তার নিজের গতিতে চলবে।”