ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর এ প্রাঙ্গণ ঘিরে পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও গবেষণাধর্মী আর একাডেমিক বইয়ের ক্রেতা কম, জানান বিক্রয় কর্মীরা।
Published : 22 Feb 2023, 11:17 PM
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের ফিল্ম আর্কাইভের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন মনোযোগ দিয়ে বই দেখছিলেন; দেখার এক ফাঁকে বইয়ের কিছু পৃষ্ঠার ছবিও তুলতে দেখা যায় তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এ দুই শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়াশোনার অংশ হিসেবে কিছু প্রয়োজনীয় বইয়ের খোঁজে এসেছেন। শাহ মাহবুব ও সানজিদা নামের এ দুই শিক্ষার্থী এ স্টলে তাদের পছন্দের বই পেয়ে সেগুলোই দেখছিলেন বলে জানান তারা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মাহবুব বলেন, তাদের পরীক্ষার জন্য ফিল্ম আর্কাইভের স্টলে কয়েকটি পাঠ্যবই পেয়েছেন তিনি; সেগুলোই দেখছেন।
“মূলত পরীক্ষার জন্যই বইগুলো দেখছি। কিছু লেখা আমাদের ক্লাসের পরীক্ষার জন্য পড়তে হবে। এছাড়া মেলায় ঘুরেও পছন্দের বই কিনব।”
ফিল্ম আর্কাইভের এ স্টলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন নির্মল রায়। এ অংশে একাডেমিক বই থাকার কারণে সাধারণ মানুষজনের সমাগম কম বলে জানালেন তিনি।
“এই অংশে লোকজন একটু কমই আসে। তবে শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা বেশি আসেন। ফিল্ম আর্কাইভে সিনেমাবিষয়ক বেশ কিছু গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইগুলো সিনেমাপ্রেমী অনেকে সংগ্রহ করতে আসেন।”
গত কয়েক বছরের মতই এবারও বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দুই অংশে বসেছে বইমেলা। বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে। তবে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের স্টলের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশিত বিভিন্ন একাডেমিক আর গবেষণাধর্মী বইয়ের সমাহার রয়েছে একাডেমির অংশে।
ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর এ প্রাঙ্গণ ঘিরে পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও এমন গবেষণাধর্মী আর একাডেমিক বইয়ের ক্রেতা কম।
মেলার বাংলা একাডেমি অংশে ঢুকতেই বাম পাশে পড়েছে মুক্তধারার স্টল। এ প্রকাশনীর হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল অমর একুশে বইমেলা। শুরুতে শুধু একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকলেও মেলার পরিসর এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও বিস্তৃত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় কবি কামাল চৌধুরীর সঙ্গে।
একাডেমির এ প্রাঙ্গণের পুরনো স্মৃতি টেনে তিনি বলেন, একাডেমি প্রান্তেই এক সময় বইমেলার আড্ডা জমত। এই পুকুরপাড়ে বসে আড্ডা দিতেন খ্যাতিমান অনেক লেখক। প্রথম দিকে তো বইমেলা হতো একাডেমির নজরুল মঞ্চের ওইখানটার বটতলায়।
“মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হলেও একাডেমি প্রান্তেও কিছু স্টল রয়েছে। প্রতি বছরই মেলায় আসার পর এ অংশেও আসা হয়। এ অংশ আমাদের অনেকের কাছেই স্মৃতিময় একটি জায়গা।”
একাডেমি প্রাঙ্গণে আছে- শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, প্রেস ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, উদীচী, কর্নেল তাহের সংসদ, জয় বাংলা আর্ট গ্যালারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টল, কপিরাইট অফিস, ইসলামি ফাউন্ডেশন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিদ্যানন্দসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের স্টল।
জাতীয় জাদুঘরের স্টলে গিয়ে যাত্রাপালার ইতিহাস, বিস্মৃত সুরশিল্পী কে মল্লিকের অপ্রকাশিত আত্মকথা, বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলাসহ অনেক বইয়ের দেখা মেলে।
স্টলের বিক্রয়কর্মীরা জানান, সাধারণত ২০ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি হলেও মেলায় তা ২৫ শতাংশ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্টলে রয়েছে পোস্টার, সিডি, বই। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ, মুক্তির গান, বাউল শিবিরের শরণার্থী তোরাব আলী সাঁই শিরোনামে সিডিও রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের স্টলে দেখা যায়- সোমপুর-পাহাড়পুর, নড়াইল জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ, প্রত্নতাত্ত্বিত অ্যালবাম, ময়নামতির লালমাই, মহাস্থানগড়, মঠেরচালার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রতিবেদন, উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রতিবেদনসহ আরও কিছু প্রকাশনা।
এশিয়াটিক সোসাইটির স্টলে রয়েছে- বাংলাদেশের ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, স্থাপত্য, পরিবেশনা শিল্পকলা, বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষসহ বিভিন্ন প্রকাশনা।
এছাড়া ফিল্ম আর্কাইভের স্টলে রয়েছে- সিনেমার পোস্টার, সিনেমার ইতিহাস, জহির রায়হানের চলচ্চিত্র সমাজ ভাবনা, সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং: বিলুপ্তপ্রায় শিল্পশৈলী, ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পটভূমিসহ বেশ কিছু গবেষণাধর্মী বই।
চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) স্টলে সচিত্র কিশোর মাসিক পত্রিকা নবারুন এর বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যায়; গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত সংখ্যাও আছে। এছাড়া তাদের অন্যান্য প্রকাশিত বইও রয়েছে।
গণহত্যা জাদুঘরের স্টলে আছে দেশের বিভিন্ন জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গণহত্যা নিয়ে গবেষণাধর্মী বই।
এছাড়া বাংলা একাডেমির স্টল, মেলার নতুন বই প্রদর্শন স্টল- বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, পরমাণু শক্তি কমিশন, টুরিস্ট পুলিশ, ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, জয় বাংলা একাডেমি, উন্মাদ, স্পর্শ ব্রেইল এর স্টল, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটের স্টলও রয়েছে একাডেমি অংশে।
মাতৃভূমি নামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্টলে গিয়ে দেখা যায়- বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা অনেক বই।
বুধবার ছিল মেলার ২২তম দিন। এদিন মেলা বিকাল ৩টায় শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে। নতুন বই এসেছে ৬৪টি।
সহ-আয়োজন
এদিকে বুধবার মেলার পাশাপাশি অন্যান্য নানা আয়োজনে মুখরিত ছিল বইমেলা প্রাঙ্গণ। এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা ও ছড়া এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত লোকায়ত সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মতিন রায়হান ও সুমনকুমার দাশ।
কামাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে তপন বাগচী, মোস্তাক আহমাদ দীন ও অনুপম হীরা মণ্ডল আলোচনা পর্বে অংশ নেন।
এছাড়া লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রফিকুর রশীদ, আহমাদ মাযহার, অদ্বৈত মারুত ও মামুন খান।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কামাল চৌধুরী, মুহাম্মদ সামাদ, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহজাদী আঙ্গুমান আরা, আহমেদ জসিম, নাজমা আহমেদ, আ র ম বাকীবিল্লাহ, চঞ্চল আখতার, নাজমুল হুসাইন, আরেফিন রব। এছাড়া কাজী রোমানা আহমেদ সোমা, মাসুদুজ্জামান, আন্জুমান আরা, রশিদ কামাল আবৃত্তি পরিবেশন করেন।
এর বাইরে মাসুম হুসাইনের পরিচালনায় নৃত্য ‘পরম্পরা নৃত্যালয়, কোহিনূর রহমান শিল্পীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'আনন্দ নিকেতন সংগীতালয় - এর পরিবেশনাও ছিল।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মোস্তাফিজুর রহমান, সালমা মোস্তাফিজ, ফারুক নূরী, এ টি এম গোলাম মোস্তফা, আমিরুল ইসলাম, মজিবুর রহমান বিরহী, রীতা ভাদুরী, আমর হাওলাদার বাবুল। নৃত্য পরিবেশন করেন সাকিবুল ইসলাম। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন তুলসী সাহা (তবলা), শাহীনুর রহমান (কি-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি) ও অরূপ কুমার শীল (দোতারা)।
বৃহস্পতিবার যা থাকবে মেলায়
বইমেলা ২৩তম দিন বৃহস্পতিবারও বিকাল ৩টায় শুরু হবে মেলা। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কথাসাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণা ও মুক্তগদ্য চর্চা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মিল্টন বিশ্বাস ও ফরিদ কবির।
আলোচনায় অংশ নেবেন গোলাম কুদ্দুছ, রফিকুর রশীদ, সুভাষ সিংহ রায়, সরিফা সালোয়া ডিনা, আলফ্রেড খোকন, মাসুদ পথিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।