কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
Published : 08 Jul 2023, 01:33 AM
দেশে সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা খুব ধীরে হলেও বাড়ছে; মোট কর্মীসংখ্যায় নারীর হার ১০ বছর আগে যেখানে ২৫ শতাংশের নিচে ছিল, এখন তা উঠে এসেছে ২৯ শতাংশের উপরে।
নারী কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক মনে করছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে উচ্চ শিক্ষায় ছাত্রীদের পাসের হার ছাত্রদের থেকে বেশি থাকায় এখন চাকরি ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
তবে শিক্ষার সব স্তরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেভাবে বেড়েছে, তাতে সরকারি চাকরির এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীদের থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
আর কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ২০২২ সালের সরকারি কর্মচারীদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে বর্তমানে ১৯ লাখ ১৫১টি অনুমোদিত পদ রয়েছে।
এসব পদের বিপরীতে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন কাজ করছেন। এর মধ্যে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ জন পুরুষ এবং ৪ লাখ ৯ হাজার ১৩৯ জন নারী। অর্থাৎ, বর্তমানে সরকারি চাকরির বিভিন্ন পদে ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ নারী কাজ করছেন।
আর এক দশক আগের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সরকারি চাকরিতে ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৯ জন কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৪ জন ছিলেন নারী, যা মোট কর্মী সংখ্যার ২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বর্তমানে ১১ জন নারী জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার পদে কাজ করছেন। আর জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন নয়জন নারী।
বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ২ হাজার ৭৪১ জন, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৭৭ জন, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ৩ হাজার ৮৬৩ জন, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনে ৪১ হাজার ৫৫৮ জন নারী কাজ করছেন।
এক সময় সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা থাকলেও ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির (বর্তমানে ৯ম-১৩তম গ্রেডের) সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা তুলে দেয় সরকার।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি চাকরিতে ধারাবাহিকভাবে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। ধীরে ধীরে আরও বাড়বে। আশা করছি আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারব।”
প্রত্যেক জায়গায় নারীরা যাতে সমান অধিকার নিয়ে কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে ফরহাদ বলেন, ২০০৫-২০০৬ সালে সরকারি চাকরিতে নারীদের যে অবস্থান ছিল গত ১৪ বছরে তা অনেক গুণ বেড়েছে।
“এখন ১১ জন নারী সচিব রয়েছেন। আগে তো কেউ এটা চিন্তাও করতে পারতেন না। প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চেষ্টা করছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এখন ৬০ শতাংশ শিক্ষক নারী।”
অগ্রগতি কীভাবে
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে নারী শিক্ষার হার বাড়া, ছাত্রীদের ঝরেপড়া ঠেকাতে মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং চাকরির নিশ্চয়তা থাকায় সরকারি চাকরিতে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছে বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক।
এই নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ায় উচ্চ শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে।
“স্থানীয় প্রশাসন বাল্যবিয়ে ও ইভটিজিং রোধ করছে। যেসব কারণে গ্রামাঞ্চলের নারী শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ত সেটা রোধ করা যাচ্ছে। ছাত্রীরা এখন উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে আগের চেয়ে বেশি।”
সায়লা ফারজানা বলেন, উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার পর নারীদের সরকারি চাকরি বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ হল, চাকরির নিশ্চয়তা। অবশ্য বেসরকারি খাতেও অনেকে যাচ্ছেন।
“সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর নারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। চাকরিতে ঢোকার পর একজন নারীর কী কী সমস্যা হতে পারে সেগুলো এখন আমাদের জানা আছে। অনেক নারী এখন মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে ডিসি, এসপি বা মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের আমরা এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারছি।”
এখন নারী কর্মকর্তাদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে সায়লা ফারজানা বলেন, “নারীরা প্রমাণ করেছে যে তারাও পারে। জুনিয়র সহকর্মীরা কাজ করার আরও বেশি সুযোগ পাচ্ছে। এসব কারণে সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে।”
ডিগ্রি পর্যন্ত ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি চালু থাকার বিষয়টি তুলে ধরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকার নারীদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করছে, তার ফল মিলছে শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে।
“বাল্যবিয়ে রোধ করতে মাঠ প্রশাসন থেকে ব্যাপকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলন হিসেবেও বাল্য বিয়ে শূন্যের কোটায় আনার চেষ্টা চলছে। ইভটিজিং বন্ধ হয়েছে। এর ফলে নারীরা পড়াশোনায় এগিয়ে যাচ্ছে।”
আরও পথ বাকি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার। তাদের মধ্যে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৯০ হাজার পুরুষ এবং ২ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার নারী।
এই হিসেবে দেশে শ্রমে নিয়োজিত মোট কর্মী সংখ্যার ৩৫ শতাংশ নারী। সেখানে সরকারি চাকরিতে এই হার ৩০ শতাংশের নিচে।
এই হার আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল মন্তব্য করে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সরকারি চাকরিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী হওয়া উচিত ছিল এতদিনে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বেশিরভাগ মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে যেতে চান। কারণ এখানে চাকরির নিশ্চয়তা আছে এবং মোটামুটিভাবে সহনীয় বেতন-ভাতা ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। মেয়েরা সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল বলে তাদের পরিবারের সদস্যরাও সরকারি চাকরিকেই প্রাধান্য দেন।”
তিনি বলেন, প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শুধু নারীর অংশগ্রহণই বাড়েনি, প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানেও নারীরা ‘খুব ভালো’ করছে।
তবে সিদ্ধান্তগ্রহণের পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারি চাকরিতে যেসব নারী কর্মরত আছেন, তাদের মধ্যে নিচের গ্রেডে বেশি সংখ্যক কাজ করছেন।
“এরপরেও ধীরে ধীরে উচ্চপর্যায়ে নারীরা যাচ্ছেন। সচিব, ডিসি, ইউএনওসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। রাষ্ট্রদূতও হচ্ছেন। নারীদের সিদ্ধান্তগ্রহণের পর্যায়ে আনতে পরিকল্পনা থাকতে হবে। নইলে যে জায়গায় আমরা দেশকে নিয়ে যেতে চাই, সেই জায়গায় নেওয়া সম্ভব হবে না।”
সরকারি চাকরিতে যাতে আরও নারীরা আসতে পারে, সেই পথ তৈরি করে দিতে হবে মন্তব্য করে মালেকা বানু বলেন, “উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরেও অনেক নারী চাকরিতে টিকতে পারছে না। তাকে নানান ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। পারিবারিক ও পেশাগত কাজের সমন্বয়ের জন্য যে ধরনের সাপোর্ট দেওয়া দরকার সেই সাপোর্ট দিতে হবে।
“ঘরে, বাইরে, পথে, যানবাহনে, আবসন ও ডে-কেয়ার সেন্টারে তাকে সেই সহযোগিতাটুকু করতে হবে। এসব সমস্যা না মেটলে কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নারীদের আনা সম্ভব হবে না।”