স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্তিতে ‘ইনসাইড আউট’ এর বিশেষ পর্বে একাত্তরের প্রতিরোধের গল্প শুনিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম।
Published : 26 Mar 2023, 12:00 PM
আলোচনার অন্তরালে পাকিস্তানিরা যে জঘন্য কিছুর পরিকল্পনা করছিল, তার ইঙ্গিত মিলছিল ১৯৭১ সালের মার্চের আগে থেকেই। প্রায় ১০ হাজার টন অস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় এমভি সোয়াত; সৈন্য নিয়ে করাচি আর অন্যান্য অঞ্চল থেকে একের পর এক আসছিল পিআইএর ফ্লাইট।
নারকীয় গণহত্যা চালানোর সেই পরিকল্পনা ঠেকিয়ে দিতে নিজেদের মত পরিকল্পনা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীরই মুক্তিকামী বাঙালি কর্মকর্তারা। তেমনই এক পরিকল্পনা আর সমর কৌশলে গণহত্যা থেকে রক্ষা পায় পুরো চট্টগ্রাম।
২৫ মার্চের কালরাতে অগ্রিম আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের হতভম্ব করে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা; সেই আক্রমণের সাফল্যের ধারায় পরবর্তী টানা ৩৯ দিন চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যান তারা।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এর বিশেষ পর্বে সেই প্রতিরোধের গল্প শুনিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম।
২৫ মার্চ রাত থেকে ২ মে পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর কথা তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বলেন, “আমরা প্রথম দিকে এমন বিপুল সাফল্য অর্জন করেছি যে, তিনটি ব্রিগেড মিলেও তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম দখল করতে এবং গণহত্যা চালাতে পারেনি।
“এরপর চট্টগ্রামে তারা আর কোনো গণহত্যা চালাতে যায়নি। আমরা যদি অগ্রিম পদক্ষেপ না নিতাম, তাহলে আমরা সবাই মারা পড়তাম।”
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও সীমান্তবর্তী এলাকায় বিচক্ষণতার সঙ্গে লড়াই পরিচালনা করেন তিনি, পরে ভূষিত হন বীরউত্তম খেতাবে।
মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রফিকুল ইসলাম পরে রাজনীতিতে আসেন। দায়িত্ব পালন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও; এখনও সংসদ সদস্য তিনি।
সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে চট্টগ্রাম সেক্টর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ছিলেন তখনকার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। তার অধীনে প্রায় ১৮শ সৈন্য ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল বাঙালি, আর বাকিরা অবাঙালি।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে, গোপনে স্বাধীনতার সংগ্রামের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “তারা পুরো বিষয় সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন, যেটা আমার ভাবনার অতীত ছিল। এ কারণে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা ছিল খুব সহজ। আমি তাদেরকে বলেছি, তোমরা যদি দেশের ভালো কিছু চাও, নিজের ও জনগণের জন্য ভালো কিছু চাও, একদিন তোমাদেরকে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে।”
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রায় ১০ হাজার টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এমভি সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রামে আসে। একইদিন করাচি এবং অন্যান্য জায়গা থেকে পিআইএ বোয়িং ফ্লাইটে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছিল পূর্বে। প্রত্যেক ফ্লাইটে ছিল ১১০-১২০ জন সশস্ত্র যোদ্ধা।
অস্ত্র আর গোলাবারুদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক সৈন্য আসতে থাকায় রফিকুল ইসলামরা অনুধাবন করতে পারেন, এই এদের আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘বাঙালিদের হত্যা করা’।
“আমার কাছে বিকল্প ছিল হয়ত চুপ করে থাকা ও কোনো কিছু না করা, অথবা সব ধরনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই এই যুদ্ধজয়ের সবচেয়ে ভালো উপায় হবে, আগেই শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে ফেলা,” বলেন তিনি।
আমি তাদেরকে বলেছি, তোমরা যদি দেশের ভালো কিছু চাও, নিজের ও জনগণের জন্য ভালো কিছু চাও, একদিন তোমাদেরকে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে।রফিকুল ইসলাম
নিজের পরিকল্পনা তৈরির কাজে ইপিআরের বাঙালি কমিশন্ড, নন-কমিশন্ড অফিসার এবং আস্থাভাজন কয়েকজন সৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন রফিকুল ইসলাম। আলোচনা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “মানুষকে আমার পক্ষে রাখা নিয়েও চিন্তা করতে হয়েছিল। কারণ, সীমিতসংখ্যক সৈন্য দিয়ে, আমি ইপিআরের অবাঙালি সৈন্যদের ধ্বংস করতে পারি, শহর দখল করতে পারি। কিন্তু দখল ধরে রাখার জন্য আমরা আরও অনেক সৈন্য দরকার এবং আমার দরকার রাজনৈতিক ও জনগণের সহযোগিতা।”
রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে খবর পাঠানো হয়, যাতে সোয়াত জাহাজ থেকে মালামাল খালাস না করা হয়। শ্রমিকরা রাজি হয়নি। অস্ত্রের মুখে খালাস করতে রাজি হলেও কেবল সেগুলোকে জেটিতে রাখা হয়েছিল।
ভিন্ন কারণ দেখিয়ে ২৪ মার্চ বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে সরিয়ে চট্টগ্রামের সাবজোনাল মার্শাল ল’ অ্যাডমিনস্ট্রেটর করে আনা হয় অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, সেদিন সন্ধ্যায় বন্দরে গিয়ে আনসারি ঘোষণা করেন, ‘এমভি সোয়াতের অস্ত্র ও গুলি যেভাবে হোক খালাস করতে হবে এবং অবশ্যই সেনানিবাসে নিয়ে যেতে হবে। যারা অস্বীকৃতি জানাবে, তাদেরকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হবে এবং তাদের লাশ নৌবাহিনীর জাহাজে নিয়ে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে’।
“এটা বার্তা দেয় যে, পাকিস্তানিরা বাঙালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করবে। আমি অনুভব করি, আজ রাতেই হয়ত তারা গণহত্যার অপারেশন শুরু করে দেবে। আমি হালিশহরে আমার সদরদপ্তরে ফোন করি।”
কৌশলগত কারণে টেলিফোনে দুটি ‘কোডেড মেসেজ’ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। যার একটি ছিল- ‘অ্যারেঞ্জ সাম উড ফর মি’ এবং অন্যটি হচ্ছে, ‘ব্রিং সাম উড ফর মি’।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রথম মেসেজটার অর্থ ছিল, তোমাদেরকে যুদ্ধ শুরু করতে হবে এবং আধা ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানিদের ধ্বংস করে দিতে হবে। দ্বিতীয়টির অর্থ ছিল, যুদ্ধ শুরু কর, পশ্চিমাদের ধ্বংস কর, করে অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে শহরের দিকে আস, এসে তোমার জন্য পূর্বনির্ধারিত স্থানে অবস্থান কর।”
এই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে এম আর চৌধুরী এবং জিয়াউর রহমানের রহমানের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি তাদেরকেও যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানাই। তারা রাজি হলেন না। তারা বললেন, ‘এখনও তো ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে, এখনই আমরা যুদ্ধ শুরু করা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে’।”
২৫ মার্চ নিজের অফিসে গিয়ে রফিকুল ইসলাম বুঝতে পারেন, ভেতরে ভেতরে বড় কিছু একটা হচ্ছে। বড় কিছু হতে যাচ্ছে রাতেই।
তিনি বলেন, “ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং পাকিস্তানে উড়াল দিয়েছেন। তার উপদেষ্টারাও বিমানে উঠে গেছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অফিসার ও সৈন্যরা আগেভাগে রাতের খাবার সেরে নিয়েছে, তারা তাদের যানবাহন অস্ত্র ও গোলা দিয়ে ভর্তি করছে।
মেশিনগান ও এলএমজি দিয়ে সামরিক যান রেডি করা হচ্ছে। যে কোনো সময়ে শহরের দিকে রওনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। ওই তথ্য জেনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বৈঠকে বসেন।
নিজেরা আলোচনা করেন যে, মিলিটারি অপারেশন শুরু হতে যাচ্ছে এবং ক্যাপ্টেন রফিক যেহেতু এটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তিনি যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা যেন নেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি হালিশহরে ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে টেলিফোন করি, সুবেদার জয়নাল সেখানে ছিল, তাকে বললাম, অপারেশন শুরু করো। সে জানত কী করতে হবে। আমি বলি, আমি আসছি।”
অপারেশন চালানোর নির্দেশ দিয়ে ২৫ মার্চ রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বাসা থেকে বের হন তিনি। দ্রুত হালিশহরের ইপিআর সদরদপ্তর দখলে চলে আসে, গ্রেপ্তার করা হয় সব অবাঙালি সৈন্যকে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “খুব কৌশলের সঙ্গে বিস্তারিত অপারেশন সাজানো হয়েছিল। বিভিন্ন প্লাটুন ও কোম্পানি শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল।
“আমি রাত সাড়ে ১১টায় সেখানে পৌঁছাই। পুরো শহর আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল, সীমান্ত এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রথম পদক্ষেপে আমি সফল হই।”
রফিকুল ইসলামের পরিকল্পনা ছিল, শহরে নিজের অধীনে থাকা ৭-৮শ’ ইপিআরের সৈন্য, চট্টগ্রামে সেনানিবাসে থাকা প্রায় ১৮শ বাঙালি সৈন্য এবং মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৮০-২০০ সৈন্য মিলিত হলে বড় একটি সংখ্যা দাঁড়াবে।
“কেবল শহর দখল নয়, এই বড় সংখ্যার সৈন্য দিয়ে আমরা বন্দর এলাকা, নৌ ঘাঁটি ও এয়ারফিল্ড দখল করতে পারব। তাহলে পুরো শহর ও চট্টগ্রাম আমাদের অধীনে চলে আসবে।”
রফিকুল ইসলাম তখন জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের একমাত্র অবাঙালি রেজিমেন্ট বালুচ রেজিমন্টকে আক্রমণের দায়িত্ব নেওয়ার। যাতে এই রেজিমেন্ট সেনানিবাসের বাঙালি সৈন্যদের আক্রমণ এবং অস্ত্রাগার ও কোয়ার্টার গার্ডের দখল নিতে না পারে।
“আমি বলেছি, যদি আপনি তাদেরকে আগে আক্রমণ করেন, পাহাড়ে চলে যাবেন এবং অবস্থান নিয়ে গুলি করবেন। তাহলে বালুচ রেজিমেন্ট আত্মরক্ষামূলক হয়ে যাবে। তাহলে বাঙালি সৈন্যরা সেনানিবাসের অস্ত্র ও গুলি দখলে নেবে এবং বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমণ করবে এবং সেনানিবাস দখলে চলে আসবে।”
২৫ মার্চ রাতে নিজের বাহিনীকে অপারেশন শুরুর আদেশ দিয়ে ডা. জাফরকে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে জিয়াউর রহমানের কাছে পাঠান রফিকুল ইসলাম। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছানোর আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন মেজর জিয়া।
বাসা থেকে বেরিয়ে মেজর জিয়ার গন্তব্য কোন দিকে ছিল, তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তমের কথায়।
তিনি বলেন, “এর মধ্যে টাইগারপাস দিয়ে একটি গাড়ি বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। আমি খুব উঁচু এলাকায় ছিলাম। আমার এক সৈন্য আইজুদ্দিন বলল, ‘স্যার এখানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যের একটি সামরিক যান, আমি কি এটা উড়িয়ে দেব? আমাদের রকেট লঞ্চার আছে’।
“আমি বললাম, না। হয়ত তারা দেখতে যাচ্ছে বন্দর এলাকা থেকে আগ্রাবাদ হয়ে সেনানিবাস এলাকা ফাঁকা কি না। যখন তারা দেখবে রাস্তা ফাঁকা, তখন প্রধান দল সব ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসবে শহর ও ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য। তখন পাহাড়ের উভয় দিক থেকে আমরা তাদের উপর গুলি করব, তাদেরকে ধ্বংস করব এবং আমরা প্রচুর অস্ত্র ও গুলি পাব।”
ওই গাড়ি আগ্রাবাদ এলাকায় যায়। পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছিল একটি পেট্রল পাম্প এলাকায় ব্যারিকেড সরানোর জন্য গাড়িটি থেমেছে। তখন আরেকটি জিপ ওটাকে অনুসরণ করছে। কয়েক মিনিট পরে যেখানে প্রথম গাড়ি থেমেছিল জিপটিও সেখানে থামে। এরপর দুটো গাড়িই ঘুরে পেছনের দিকে যেতে থাকে। এরপর মূল বহর আসার অপেক্ষা করছিলেন ক্যাপ্টেন রফিকেরা।
“কিন্তু মূল বহর আসেনি। পরে আমরা জানতে পারি, প্রথম গাড়ি মেজর জিয়াকে বন্দর এলাকায় নিয়ে যাচ্ছিল, তিনি সেখানে যাচ্ছিলেন সোয়াত জাহাজ থেকে সেনানিবাসের দিকে অস্ত্রশস্ত্র নেওয়ার জন্য,” বলেন রফিকুল ইসলাম।
ডা. জাফর অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে না পেয়ে আরেকজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি খালেকুজামান নামে আরেক অফিসারকে পাঠান মেজর জিয়াকে সমুদ্রবন্দরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “সৌভাগ্যক্রমে, যেহেতু ব্যারিকেড তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছিল, দ্বিতীয় জিপ আসে এবং জিয়াকে পুরো বিষয় বললো, তখন উভয় জিপ ফিরে যায়। যেটা আমি পরে জানতে পারি।
“জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের দিকে না গিয়ে কালুরঘাটের দিকে রওনা করেন। যখন তারা শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বালুচ রেজিমেন্ট সুযোগটা নেয়। প্রথম কাজ তারা করে, কর্নেল চৌধুরীকে হত্যা করে।
“ফলে সেনানিবাসে বাঙালি সৈন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিল না। এরপর বালুচ রেজিমেন্ট সেখানে এক হাজারের বেশি বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে, কারণ তাদের কাছে অস্ত্র ছিল না, সেগুলো ছিল অস্ত্রগারে। অন্যরা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায় আর কেউ কেউ আমার হালিশহর এলাকায়ও আসে। এটা ছিল আমার জন্য বড় সেটব্যাক।”
২৬ মার্চ ভোর ৪টার দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর বাহারের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন রফিক বার্তা পান ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেড প্রায় একশ গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা করেছে।
খবর পেয়ে সুবেদার মুসার নেতৃত্বে হালিশহর থেকে কুমিরা এরিয়ায় অ্যামবুশ করার জন্য পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে ব্রিগেডিয়ার শফির পুরো ব্রিগেডের উপর আক্রমণ করা হয়। ৭২ অফিসার ও সৈন্য খতম হয়। কোনোমতে পালিয়ে রক্ষা পান ইকবাল শফি।
সীমিতসংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি রেলওয়ে পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার করি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সেনা মোতায়েন করা হয়।
কোনোমতে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও অস্ত্রের কোনো জোগান নেই, যা আছে তাও ফুরিয়ে এসেছে। রফিকুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নিলেন অস্ত্রের জন্য ভারত সরকারের দ্বারস্থ হবেন।
৩১ মার্চ খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে সাব্রুম হয়ে আগরতলায় যান রফিকুল ইসলাম। সেখানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা হয় তার।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “তিনি দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন। সম্ভবত তিনি বলেছেন, কিছু অস্ত্র দেওয়ার জন্য এবং আমি কি দিল্লিতে যেতে পারব কি না। আমি বলি, আমাকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে।
“এর মধ্যে চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নানরাও ওই সময়ে আগরতলায় চলে আসেন। আমি শচীন সিংকে বললাম, এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চলে এসেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকুন আর আমাকে কিছু অস্ত্র ও গুলি দিন, যাতে আমি গিয়ে যুদ্ধ করতে পারি।”
তিনি বলেন, “আমরা তিনটি পৃথক জোনে যুদ্ধ করছিলাম। একটি হলো ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে, ফটিকছড়ি-চট্টগ্রামের পাহাড়ি রাস্তা এবং কালুরঘাট এলাকায়, যেখানে মেজর জিয়া তার সৈন্যদের নিয়ে গেছেন।
“আমরা সব যুদ্ধে ব্যাটলে ভালো করছিলাম, কিন্তু পর্যাপ্ত সৈন্য না থাকায় ও অস্ত্রশস্ত্র পর্যাপ্ত না পাওয়ায় আমরা দখল রাখতে পারছিলাম না। আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছি আর এর মধ্যে শহরেও পতন হয়। সুতরাং আমরা পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে থাকি, যাতে তারা শহরের মধ্যে থাকে এবং বাইরে গিয়ে দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে না যায়।”
আমি তাদেরকেও যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানাই। তারা রাজি হলেন না। তারা বললেন, ‘এখনও তো ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে, এখনই আমরা যুদ্ধ শুরু করা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে’।এম আর চৌধুরী ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে রফিকুল ইসলাম
এভাবে ২ মে পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে রামগড় রক্ষার লড়াইয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তাদের।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা যখন রামগড়কে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই, তার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী খাগড়াছড়ি, নারায়ণহাট, কয়রার হাট এলাকা থেকে সেদিকে আসতে শুরু করে।
“তার মানে হচ্ছে, তিন দিক থেকে আসছে ট্যাংক, কামান নিয়ে আর যুদ্ধবিমান আমাদের অনুসরণ করছে। সে কারণে আমরা রামগড় ধরে রাখতে পারিনি।”
জেনারেল এমএজি ওসমানীর নির্দেশে ২ মে রামগড় থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে ভারতের সাব্রুম হয়ে হরিনায় চলে যায় ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনী।
তিনি বলেন, “তিনি (ওসমানী) পরবর্তীতে যুদ্ধের জন্য আমাদের সৈন্যদের বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন। সুতরাং ২ মে তিনি আমাদের সব সৈন্যকে রামগড় থেকে সাব্রুমে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং নতুন সদরদপ্তর হরিনায় যেতে বলেন, যা সাব্রুম থেকে ভারতের ছয় কিলোমিটার ভেতরে। আর সেটাই পববর্তীতে ১ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর হিসাবে ছিল।”
পরে ১০ থেকে ১৫ জুলাই কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনে বাংলাদেশকে ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ঠিক করা হয় যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল। ১০ জন সেক্টর কমান্ডারের পাশাপাশি তিনজন ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পান। রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ১ নম্বর সেক্টরের।
তারপর লড়াই চলে সংগঠিত ভাবে, রাজনৈতিক তৎপরতায় আসে আন্তর্জাতিক সমর্থন: শেষ দিকে ভারতও যোগ দেয় যুদ্ধে, গঠিত হয় যৌথবাহিনী।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বাংলাদেশের বিজয়।