নতুন কর্মতৎপরতার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে এ কূপ। চেষ্টা করলে যে অবশ্যই পারা যায়, এটি তার একটি প্রমাণ, বলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।
Published : 17 Feb 2024, 11:34 PM
প্রায় আড়াই হাজার মিটার ভূগর্ভ থেকে অতি উচ্চ চাপে আসছে গ্যাস, পাওয়া গেছে গ্যাসের তিনটি স্তর; ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি দূরত্বে তেলের সন্ধানও মিলেছে একই কূপে। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে পাওয়া এমন তথ্যে সেখানে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার খোলার আশা দেখছে সরকার।
সিলেটের তামাবিল অঞ্চলে ৮ দশমিক ৪৮ একর এক ফসলি জমিতে এমন একটি সফল অনুসন্ধান কূপ সরকারি নীতি নির্ধারকদের ব্যাপক আশাবাদী করে তুলছে।
দেশের প্রধান গ্যাস সরবরাহকারী অঞ্চল সিলেটের এ কূপ থেকে ভালো কিছু পাবার আশায় পরিকল্পনাও সাজাচ্ছে এ গ্যাসফিল্ড দেখভালকারী সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি।
‘নিশ্চিত’ সম্ভাবনা মাথায় রেখেই সিলেট-১০ নম্বর কূপ হিসেবে চিহ্নিত এ কূপের কাছাকাছি আরও দুটি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানি। সেখানে গ্যাসের পাশাপাশি তেল পাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
শনিবার প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “আমরা আশাবাদী এ এলাকায় আরও অনেক বড় সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আমাদের নতুন কর্মতৎপরতার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে সিলেট ১০ নম্বর কূপ। চেষ্টা করলে যে অবশ্যই পারা যায়, এটি তার একটি প্রমাণ।”
শিগগির এ কূপের তেল উত্তোলনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ব্যবহারে চেষ্টা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "আগামী দুই মাসের মধ্যে এখানে তেলের রিজার্ভ কতটুকু আছে সেটা জানা যাবে। এখানে আমরা আরও দুটি কূপ খনন করব। এখানে মোট তিনটি স্তরে গ্যাস পাওয়া গেছে যার চাপ অনেক বেশি।“
এ কূপ এলাকার পরিদর্শনের সময় শনিবার তিনি বলেছেন, এ জন্য সিলেট গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনে আরও দুটি রিগ নিতে বলা হয়েছে।
“আপনারা আরও ৫/৬ কূপ খননের প্রস্তুতি নেন। আগামী দুই বছরে আমরা সম্ভাবনার দিক দেখতে চাই।“
কী আছে সিলেট-১০ নম্বর কূপে
সিলেটের তামাবিলে অবস্থিত এ কূপ খননের কাজ করছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড। এখানে চলতি বছরের মধ্যে আরও একটি গ্যাস কূপ ও পরে একটি তেল কূপ খনন করা হবে।
অনুসন্ধানের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গ্যাসক্ষেত্র কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রথম কূপ থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে এবং দ্বিতীয় কূপ থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এ কূপ খননে ২০২১ সালের অক্টোবরে ২০২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। খনন ঠিকাদার হিসেবে চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাকের সঙ্গে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে টার্ন কি চুক্তি সই করে কর্তৃপক্ষ।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে ৮ দশমিক ৪৮ একর জমিতে কূপের খনন কাজ শেষ হয়েছে। এ কূপে ৪টি স্তরে গ্যাস ও ১টি স্তরে তেল পাওয়া গেছে। ২৫৪০ হতে ২৫৬৫ মিটার গভীরতায় ডিএসটি চলাকালীন দৈনিক ২২-২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস প্রবাহের বিপরীতে ওয়েলহেড প্রেসার ৩২৫০ পিএসআইজি। এ স্তর থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া ১৩৯৭ হতে ১৪৪৫ মিটার গভীরতায় টেস্ট করে ক্রুড অয়েল পাওয়া যায় যার এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি। স্বয়ংক্রিয় প্রেসারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল হারে তেল প্রবাহিত হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর এ কূপের ৯ হাজার লিটার তেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিক হিসাবে এ স্তরে তেলের মজুদ প্রায় ৮ মিলিয়ন ব্যারেল যার মূল্য ৭ হাজার কোটি টাকা।
এখানে গ্যাসের মজুদ রয়েছে ৪৩ বিসিএফ, যার ভারিত গড় মূল্য প্রায় ৩২৭৩ কোটি টাকা। আমদানি করা এলএনজি'র মূল্য বিবেচনায় উপজাতসহ এ পরিমাণ গ্যাসের মূল্য ৮ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। কূপ দুটির মাধ্যমে দৈনিক ৩৫ হতে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা হলে ৮/১০ বছর ধরে গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যাবে।
জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস
শনিবার বাপেক্সের পরিচালনায় কৈলাশটিলা-৮ নম্বর কূপের চলমান খনন কাজ, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির সম্প্রসারিত প্রসেস প্লান্ট, সিলেট ১০ নম্বর অনুসন্ধান কূপের সদ্য সমাপ্ত খনন কাজ পরিদর্শন করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
এখন ৪৬টি কূপ খননে সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন আরও ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আগানো হচ্ছে। তাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশি কূপগুলো থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে দৈনিক আরও ৬০০ এমএমসিএফডির (মিলিয়ন ঘনফুট) কিছু বেশি গ্যাস যুক্ত হবে। ফলে এখনকার দৈনিক এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতির বড় যোগানদাতা হবে দেশীয় এসব উৎস।
সরকার এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে গ্যাস আমদানি করে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে দিচ্ছে তাতে প্রতি ইউনিটে ৬০ টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। একই পরিমাণ দেশি গ্যাসের মূল্য মাত্র ৪ টাকা হওয়ায় তা গ্যাসের যোগানে বড় ধরনের অর্থ সাশ্রয় করবে বলে তার আশা।
পরিদর্শনকালে একাধিক স্থানে দেওয়া বক্তব্যে সরকারি কোম্পানিগুলোকে আরও গতিশীল ও কর্মদ্দীপক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
নসরুল হামিদ বলেন, “আমরা যে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে চাই সেই লক্ষ্য পূরণে যত শিগগিরই হোক আমাদেরকে গ্যাসের অনুসন্ধানে নেমে পড়তে হবে। এখন আর বসে থাকার সময় নেই।“
সিলেট ১০ নম্বর কূপে গ্যাসের পাশাপাশি তেল আবিষ্কৃত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন অ্যাসেসমেন্ট চলছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে জানা যাবে যে, কী পরিমাণ তেল এখানে পাওয়া যাবে, রিজার্ভ কতটুকু আছে সেটা জানা যাবে।
“আমরা বর্তমানে একটা ড্রিল করেছি, আরেকটা ড্রিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখানে আমরা সর্বোচ্চ গভীরতায় গেছি। সেখানে প্রায় ছয় হাজার পিএসআই গ্যাসের চাপ পাওয়া গেছে। এটা হবে বাংলাদেশের তেল আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান একটি প্রজেক্ট।“
গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে পরীক্ষিত বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। তারা আশা করছেন এখানে আরও বেশি তেলের সন্ধান মিলবে। সেজন্য কাছাকাছি জায়গায় আরেকটি কূপ খনন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তেলের পাশাপাশি গ্যাসও পাওয়া যাওয়া সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।“
চলমান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাপেক্স কতটা সক্ষম? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রথমদিকে বাপেক্সের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন তা নেই।
“আমরা তাদেরকে আরও সক্ষম করার চেষ্টা করছি। বাপেক্সের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি। এমন কী এখন শেভরন যে কূপ খনন করছে সেখানে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে দেখছি। সবকিছুতে আমরা ভালো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।“
তিনি বলেন, "৪৬টি কূপ খননের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের একসঙ্গে ছয়টা রিগ লাগবে। কিন্তু বর্তমানে বাপেক্সের রয়েছে মাত্র চারটি রিগ। কিন্তু এখন যে ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছি সেখানে সমান্তরালভাবে আরও ছয়টি রিগ প্রয়োজন।
“এখন রিগের জন্য আমরা তো বসে থাকতে পারি না। সে কারণেই বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে আমরা কূপ খনন চালাচ্ছি।"
সিলেটের ৫০ হাজার গ্রাহক পেলেন গ্যাসের প্রিপেইড মিটার
দক্ষতা না দেখাতে পারলে টিকবে না বাপেক্স: প্রতিমন্ত্রী
সিলেটে তেলের মজুদ পাওয়ার খবর দিলেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
সিলেটে পরিত্যক্ত কূপে প্রতিদিন মিলবে ‘১০ মিলিয়ন’ ঘনফুট গ্যাস