মানবাধিকার সংগঠনগুলোও চাপে: আসক

“এরকম যে আমাকে কম্বল জড়িয়ে আঘাত করা হচ্ছে, তাতে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে না,” বললেন নূর খান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2022, 12:09 PM
Updated : 31 Dec 2022, 12:09 PM

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ‘বিভীষিকাময়’ হিসেবে বর্ণনা করেছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

শনিবার ঢাকার লালমাটিয়ায় সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এখন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।

এই ভয়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আমি কোন কথাটি বলব, বলার পরে আমার বা আমার সংগঠনের ওপর কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, এই ভয় নিয়েই আমাদের কথা বলতে হয়। তাতে সেল্ফ সেন্সরশিপ চলে আসে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উপর খড়গ নেমে এসেছে। একটি সংস্থা অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এটা যে বার্তা দেয়, তাতে আমাদের কাজের পরিধি সংকুচিত হয়ে আসে।

“এককথায় বলতে গেলে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। ভেতরের পরিস্থিতি অনেকটা এরকম যে আমাকে কম্বল জড়িয়ে আঘাত করা হচ্ছে, তাতে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে না।”

‘মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২২: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পরিচালক (প্রোগ্রাম) নিনা গোস্বামী ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “সরকারের চাপে ও ভয়ে মানুষের ওপর নিপীড়নের সব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে না। গুমের মতো ভয়াবহ নিপীড়নের অনেক ঘটনাও সামনে আসছে না।

“এছাড়া যে কোনো প্রতিবাদ বা রাজনৈতিক কর্মসূচির পূর্বে ও পরে গায়েবি মামলা দায়ের এবং গণহারে গ্রেপ্তার করা যেন নিয়মিত চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

গুমের ঘটনাগুলো ‘সেভাবে’ প্রকাশ পাচ্ছে না মন্তব্য করে নূর খান বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগজনক। একজন ব্যক্তিকে যে সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে এবং যে সময়ে তাকে ধরে আনার কথা বলছে পরিবার, এর মধ্যে আমরা বিস্তর ফারাক পাচ্ছি। আমাদের নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানে এরকম অনেকগুলো ঘটনা উঠে এসেছে যে, অনেককে তুলে নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি, গ্রেপ্তারের বিষয়টিই অস্বীকার করা হয়েছে।

“এটি খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে আমরা দেখেছি যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তাদের জঙ্গি তকমা দেওয়াও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু ইতিমধ্যে ছাড়া পেয়েছে।”

আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “তার মানে হচ্ছে জনগণের কিন্তু এখন পর্যন্ত জীবনের যে অধিকার সেগুলোর সবগুলোর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যক্তিকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। পরবর্তীতে বলা হচ্ছে, গতকাল বা গত পরশু তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের কাছে এরকম অনেকগুলো তথ্য এসেছে যে, যেভাবে বলা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশিদিন তাদের আটক রাখা হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে করোনার টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা অস্থিরতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে। তবে দেশে বিচারহীনতা সংস্কৃতি চলমান রয়েছে। তনু কিংবা ত্বকী হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ পিছিয়েছে ৯৪ বার।”

দেশে এ বছর কমপক্ষে ৩৬ বার ১৪৪ ধারা জারির তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, এর মধ্যে সর্বাধিক ১২ বার জারি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে।

গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করতে গিয়ে বিএনপি বাধার সম্মুখীন হয়েছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিএনপি যেমন নানা বিপত্তি বা বাধার সম্মুখীন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষকেও পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় কষ্ট।

“সমাবেশের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। এ ধরনের অঘোষিত ধর্মঘটে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে। ধর্মঘটের কারণে জনদুর্ভোগ তীব্রতর হয়ে উঠে, চিকিৎসাসহ নানা জরুরি প্রয়োজনে মানুষ যাতায়াত করতে পারেনি।

“এমনকি বিএনপির সমাবেশে যোগদানের ‘অপরাধে’ বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তালা দিয়ে রাখার এবং ভাঙচুর করার অভিযোগও উঠেছে স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে। আসকের তথ্যানুসন্ধানে সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়ার কারণে বরিশালের আগৈলঝড়ায় বিএনপি সমর্থকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করাসহ দোকান মালিকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।”

মানুষের ‘গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার লঙ্ঘনের’ কথা তুলে ধরে আসকের কর্মকর্তারা লিখিত বক্তব্যে বলেন, “১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে উপলক্ষ করে পুলিশ যাত্রীদের মুঠোফোন ঘেঁটে ছবি, ক্ষুদে বার্তা ও কল তালিকা দেখে বোঝার চেষ্টা করে কোনোভাবে তারা বিএনপির সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন কিনা। এছাড়া নীলক্ষেত এলাকায় স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পথচারীদের যাকে সন্দেহ হয়েছে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের বিরুদ্ধে গাজীপুরসহ কয়েকটি জায়গায় এ ধরনের হয়রানিমূলক আচরণের অভিযোগ উঠে। অথচ গোপনীয়তা একজন ব্যক্তির সংবিধান স্বীকৃত (অনুচ্ছেদ ৪৩) অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার।

“এছাড়া যে কোনো প্রতিবাদ বা রাজনৈতিক কর্মসূচির পূর্বে ও পরে গায়েবি মামলা দায়ের এবং গণগ্রেপ্তার পরিচালনা করা যেন নিয়মিত চর্চা হয়ে দাড়িয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে পুলিশের ১৫ দিনের (১ ডিসেম্বর-১৫ ডিসেম্বর) বিশেষ অভিযানে ২৩ হাজার ৯৬৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় ৩৩ হাজার ৪২৯টি অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত রয়েছে ৭২ জন। পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা অভিযান বলা হলেও বিএনপির অভিযোগ, এ অভিযানে তাদের বিপুল সংখ্যককর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

‘বন্দুকযুদ্ধের’ হিসাব তুলে ধরে আসক জানায়, ২০২২ সালে সারাদেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৫ জন। সরকার গুমের ঘটনা বারবার অস্বীকার করলেও চলতি বছর অপহরণ ও গুম হয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, বাকিরা ফিরে এসেছেন।

“বছরজুড়ে ২২৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। নিহত হয়েছেন একজন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলা হয়েছে ৭৯ জন সংবাদকর্মীর ওপর।”

ধর্ষণের হিসাব তুলে ধরে বলা হয়, “এক বছরে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন নারী। পরে হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৪৭৯ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন। ২০২২ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৫১৬ জন শিশু।

“এই সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৬০ জন শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০০ জন শিশু এবং যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু।”

পরিস্থিতির পরিবর্তনে সংস্থাটি ১৪ দফা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা এবং সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এ আইনে মামলা গ্রহণ না করার নির্দেশনা দেওয়া।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যে কোনো ধরনের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা’ যেমন- বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা, এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা।