একাত্তরে ‘হারানো’ বাবার খোঁজে ৫৩ বছর

ক্যাপ্টেন আর এ এম খায়রুল বাশার নিখোঁজ হয়েছিলেন একাত্তরের মাঝামাঝি। স্বজনরা পরে জানতে পারেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন করে হত্যা করা হয় তাকে। মরদেহের খোঁজ আর মেলেনি।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2024, 04:16 PM
Updated : 25 March 2024, 04:16 PM

ইকবাল বাশারের বয়স বাংলাদেশের প্রায় সমান। বাবার মুখ কখনো দেখেননি, ছবি আর স্বজনের কাছে শোনা গল্পে মনের কোণে এঁকেছেন তার অবয়ব।

মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় যখন তিনি মায়ের গর্ভে, তার বাবা ক্যাপ্টেন আর এ এম খায়রুল বাশার নিখোঁজ হন, যিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে থেকেও বিদ্রোহ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য।

ধরে নেওয়ার পর বাশারকে হত্যা করা হয়েছে- শুধু এ তথ্যটি পেয়েছে তার পরিবার। তাদের আর জানা নেই কিছুই। তার শেষ শয্যা কোথায় হয়েছিল, মৃত্যুর আগের দিনগুলো কেমন ছিল, সব বিষয়েই অন্ধকারে স্বজনরা।

চারদিকে যুদ্ধ, গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি, স্বজনহীন এক বৈরী পরিবেশে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে জন্ম হয় ইকবালের। তার আগে তার মা নুরুন্নাহারের কাছে তার স্বামীর সেনা ইউনিফর্ম দিয়ে যান এক পাকিস্তানি সহকর্মী। কিন্তু তার কী হয়েছে, সেটা জানিয়ে যাননি তিনি।

যুদ্ধ থামার পর সেনাবাহিনীতে কর্মরত স্বজন ও বন্ধুদের মাধ্যমে তারা শুনতে পান, ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ১৯৭১ সালের ২৯ মে ক্যাপ্টেন বাশারকে হত্যা করা হয়।

শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে ২৯ মে বাবার মৃত্যুদিন হিসেবে পালন করেন ইকবাল ও তার বোন গুলনাহার বাশার পান্না। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা জানতে পারেননি, তাদের বাবার দেহাবশেষ কী করেছে পাকিস্তানিরা। স্বামীর শেষ শয্যার খোঁজ না জেনেই ১৯৯২ সালে মারা যান নুরুন্নাহার।

যুদ্ধ শেষে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সিপাহীপাড়া গ্রামে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থিতু হয়েছিলেন নুরুন্নাহার। ইকবাল বাশারের স্থায়ী ঠিকানাও সেখানে। তার বোন গুলনাহার বাশার স্বামীর সঙ্গে থাকেন দিনাজপুর শহরে।

সিপাহীপাড়ায় কথা হয় ইকবাল বাশারের সঙ্গে।বাবার জন্য গর্বিত হলেও সারাজীবনে একবারও বাবার মুখ না দেখতে না পারার আক্ষেপ এখনো বয়ে বেড়ান ৫৩ বছর বয়সী মানুষটি। না দেখা বাবার কথা বলতে বলতে বারবারই গলা ধরে আসে তার।

কী ভূমিকা ছিল ক্যাপ্টেন বাশারের?

ইকবালের স্মৃতির সবই তার বাবার সহকর্মী ও প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা কথা।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন, তখন সাধারণ বাঙালিদের মত সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মনেও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। তারাও ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখন আমার বোন খুবই ছোট। ওই ঘোষণার পর আমার বাবা আমার বোনের প্যারাম্বুলেটরে বাংলাদেশের একটি পতাকা বেঁধে ঘুরেছিলেন বলে আমরা শুনেছি।”

কোনো নথিপত্র বা বইয়ে বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে?

ইকবাল বলেন, “না, আমাদের কাছে এমন কোনো নথিপত্র নেই। আমরা এই গল্প পরে বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি। আমার মাও একই রকম গল্প আমাদের বলেছিলেন।

“আমার বাবা যে সময় মারা যান, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত। সেখানকার স্টেশন সাপ্লাই ডিপোর (এসএসডি) অফিসার কমান্ডিং হিসেবে তার পদায়ন ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চের দিকে পাকিস্তানের বালুচ রেজিমেন্ট এসএসডির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কয়েকবার আক্রমণ করে। আমার বাবা সে সময় যেহেতু অফিসার কমান্ডিং ছিলেন, তিনি তার অনুগত বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে সেটা প্রতিহত করেন।

“এক পর্যায়ে তারা আর পেরে ওঠেননি। তখন উনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তখনকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন।”

তার মৃত্যুর বিষয়ে কী তথ্য রয়েছে- এই প্রশ্নে ইকবাল বলেন, “উনি (ক্যাপ্টেন বাশার) কোন সময়ে ধরা পড়েন, সে বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। উনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন সেই তথ্যটুকু আমরা জানতে পেরেছিলাম। তবে এরপরে কী হল সেটা এখনো জানি না।

“তবে তার কিছু সহকর্মী আমার মাকে বলেছিলেন, যুদ্ধের এক পর্যায়ে উনি (বাশার) পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার পর তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটা ইন্টারোগেশন সেল ছিল। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ব্যাপকভাবে নির্যাতন করা হয়।”

দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে নানা বাড়িতে

এই পর্যন্ত বলে গলা ধরে আসে ইকবালের। চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সাক্ষাৎকার থামাতে হয়।

একটু ধাতস্থ হয়ে তিনি বলেন, “৭ জুলাই আমার জন্ম হয় ঢাকায়। সে সময় আমার মায়ের আশপাশে তেমন কেউ ছিল না। আমার একজন দাদার বাসায় তখন মা ছিলেন। যুদ্ধের শেষ দিকে মা আমাদের নিয়ে অনেক কষ্টে পঞ্চগড়ের গ্রামে চলে আসতে সক্ষম হন। সেই থেকেই আমরা এই নানার বাড়িতে, এখানেই আমাদের বেড়ে ওঠা।

“আমার দাদার বাড়ি ছিল নীলফামারী। দুই পরিবার থেকে আমাদের নানার বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। আমার নানা ডাক্তার সলিমুল্লাহ ছিলেন এই অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। আমার মা মারা গেলেন ১৯৯২ সালে। তখনো আমার পড়াশোনা শেষ হয়নি।”

বাবা-মা দুজনকেই অল্প বয়সে হারিয়ে দুই ভাই-বোনের জীবন কেমন রূপ পেল?

ইকবাল বলেন, “কী বলব, চলছে আর কী? জীবন তো আসলে থেমে থাকে না। জীবন তার গতিতেই চলে গেছে।”

দেহাবশেষের খোঁজে

ইকবাল বাশারের বোন গুলনাহার বাশার বাবার দেহাবশেষের খোঁজ চেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো প্রবন্ধগুলোর মূল ভাষ্য একই।

তিনি লিখেছেন, “আমার বাবা চট্টগ্রাম সেনানিবাস স্টেশন সাপ্লাই ডিপোর প্রাক্তন অফিসার কমান্ডিং বিএ ৬৯৬৬ ক্যাপ্টেন আর এ এম খায়রুল বাশার, যিনি ক্যাপ্টেন বাশার হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মে বাংলাদেশের কসাই জেনারেল টিক্কা খানের অধীনে ক্র্যাক ফোর্সের হাতে নিহত হন। জানা যায়, জনৈক মেজর সরফরাজ সেই ক্র্যাক ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিল।

“পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে মেজর সরফরাজ এক জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বাবা সরাসরি এ প্রস্তাব নাকচ করেন। তৎকালীন ধানমন্ডি ২০ নম্বর রোডের ৬২৩ নম্বর বাসায় (আমার ছোট দাদি বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত বেগম আয়শা জাফরের বাসায়) তখন আমার মা নূরুন্নাহার বাশার গৃহবন্দি ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা মায়ের কাছে বাবার দেহাবশেষ হস্তান্তর করেনি।

“তখন মা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আমার ছোট ভাই ইকবাল বাশার বাবু মায়ের গর্ভে ছিল। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম মায়ের ওপর কঠোর নজরদারি করতেন। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম বাবার সামরিক পোশাক আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন।”

নথি ও সহকর্মীর বয়ান

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের নবম খণ্ডে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরী বীরবিক্রমের (পরে সিলেটের সংসদ সদস্য) একটি সাক্ষাৎকারে ক্যাপ্টেন বাশারের বিষয়টি আসে। এরপর তার কী হল সে বিষয়ে তেমন কোনো দলিলপত্র পাওয়া যায়নি।

ওই সাক্ষাৎকারে এনামুল হক চৌধুরী বলেন, “ইবিআরসির বাইরে একটি ফ্ল্যাটে আমাদের চারজন অফিসার ছিলেন। আসার পথে তাদের বাইরে নিয়ে আসতে যাই। আমাকে দেখে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ছেন বলে মনে হল। আমাকে দেখার সাথে সাথে তারা ইবিআরসির ভেতরের অবস্থা জানতে চান।

“সেখানে ছিলেন মেজর রেজাউল রহমান (মেডিকেল স্পেশালিস্ট), মেজর আশরাফ (রেডিওলজিস্ট), ক্যাপ্টেন বাশার (আর্মি সাপ্লাই কোর) ও ক্যাপ্টেন মোহসীন (অ্যাডজুটেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)। তাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা তো মনে করেছিলাম ইবিআরসিতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ফাঁকা আওয়াজ করেছে।’ জবাবে আমি বলি, ‘এক হাজারের অধিক লোককে তারা বেয়নেট বুলেট ও অন্যান্য মারণাস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।’এ কথা শোনা মাত্রই মেজর রেজাউল রহমান সকলকে আমার সাথে শহরের দিকে চলে যেতে বলেন। পরিবারের সকলকে নিয়ে আমরা যাযাবরের মতো শহরের দিকে রওনা হই।”

শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম সে সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। ক্যাপ্টেন খায়রুল বাশারের কথা মনে থাকার জানিয়ে তিনি বলেছেন, “২৬ মার্চের পর ক্যাপ্টেন বাশারের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল। তিনি স্টেশন স্টাফ অফিসার ছিলেন, সাপ্লাই কোরের। উনাকে আমরা ২৬ মার্চের পর একদিনই পেয়েছি, আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন কালুরঘাট ব্রিজে। তারপরে আর আমার সঙ্গে দেখা হয়নি বা তার কোনো খবর আমরা পাইনি।”

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “পরে আমি যখন নিজে আহত হয়ে যুদ্ধবন্দি হই পাকিস্তানিদের হাতে, প্রিজনার্স ক্যাম্পে থাকাকালে আমি অন্যের মুখে শুনতে পাই যে উনি নাকি পাকিস্তানিদের কাছে গিয়েছিলেন। তারপরে তারা উনাকে ঢাকায় এনে ইন্টারোগেশনের নামে টর্চার করে হত্যা করে।”

কী দিল রাষ্ট্র

খায়রুল বাশারের এই আত্মত্যাগ ভুলে যায়নি দেশ। স্বাধীনতার পর ক্যাপ্টেন বাশারের স্ত্রী নুরুন্নাহার বাশারকে ঢাকার বনানী ডিওএইচএস এ জমি বরাদ্দ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে সরকারি ভাতাও তিনি পেয়েছেন।

পরে সেই জমিতে নির্মাতা কোম্পানিকে দিয়ে ভবন তৈরি করিয়েছেন ইকবাল বাশার। নিজে পাথরের ব্যবসাসহ ঠিকাদারি ব্যবসা করেন।

ইকবাল বলছিলেন, তার দাদার বাড়ি নীলফামারীতে। তার সম্মানে সে জেলায় ঢোকার তোরণটির নামকরণ করা হয়েছে ক্যাপ্টেন বাশারের নামে।

ঢাকা সেনানিবাসের একটি সড়কের নামেও আছে শহীদ ক্যাপ্টেন বাশারের স্মৃতি। খুলনা জাহানাবাদ সেনানিবাসের প্রধান ফটকটি ‘শহীদ ক্যাপ্টেন বাশার গেট’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।

এসবের জন্য গর্ব অনুভব করলেও বাবাকে না পাওয়ার আকুতি তার রয়েই গেছে।