সোমবার জাতীয় শোক দিবসের ছুটির দিনে কাজ করার কথা না থাকলেও ঠিকাদার কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল বলে জানিয়েছেন সচিব।
Published : 16 Aug 2022, 05:13 PM
ঢাকার উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার আছড়ে পড়ে হতাহতের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
তিনি বলেন, “প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা, গাফলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। গতকাল (সোমবার) কাজ করার কথা ছিল না, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল।”
সোমবার বিকালে উত্তরার জসিম উদদীন সড়ক এলাকার প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনের সড়কে ক্রেইন দিয়ে গার্ডার ট্রেইলারে তোলার সময় এটি পড়ে একটি গাড়ির উপর। তাতে গাড়ির পাঁচ আরোহী নিহত হন। আহত হন দুজন। তারা সবাই এক পরিবারের সদস্য।
পরে সন্ধ্যায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব আমিন উল্লাহ নূরী ঘটনাস্থলে পরিদর্শন শেষে সরকারের তরফে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের কথা জানান।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি মঙ্গলবার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জানান সচিব আমিন উল্লাহ নুরী।
গার্ডার পড়ে নিহত ৫: তদন্তে কমিটি
গার্ডার দুর্ঘটনা: ক্রেইন চালক, ঠিকাদার কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা
গার্ডার দুর্ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কিছু বিষয় সেখানে উঠে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের তদন্তের মূল বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েছি, আরও দুই দিন লাগবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেতে। চারটি কারণ তারা জানিয়েছে।
“এর মধ্যে- কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট টিম লিডার মিস্টার টিক বলেছেন, ১৫ অগাস্টে জাতীয় শোক দিবস থাকায় গার্ডার হস্তান্তরের কোনো সেগমেন্ট ছিল না।
“কনসালটেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী, গতকাল কাজ বন্ধ ছিল। কনসালটেন্টের মাধ্যমে প্রত্যেকটা গার্ডার সেগমেন্টের কাজ পরিচালনা করা হয়। একটি বক্স গার্ডার সেগমেন্ট হস্তান্তর করার পরে দ্বিতীয়টির সময় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।”
সচিব বলেন, “ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলাই কারণ; বন্ধের দিন কাজ করার কথা নয়। এটা কিন্তু কোনো ওয়ার্কপ্ল্যান ছিল না।”
দ্বিতীয় কারণ তুলে ধরে সড়ক সচিব বলেন, “কাজ শুরু করলেও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টকে কাজের বিষয়ে অবহিত করা হয়নি। কাজ করতে চাইলে, তার উচিত ছিল ট্রাফিককে জানানো।”
তৃতীয় কারণ জানিয়ে নুরী বলেন, “দুর্ঘটনার সময় সড়কটির এক অংশ উঁচু এবং এক অংশ নিচু ছিল, ফলে ক্রেইনটি যখন কার্যক্রম চালাইতেছিল, তখন এর একটি চেইন রাস্তার উঁচু অংশে এবং অপর চেইনটি রাস্তার নিচু অংশে ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবে ক্রেইনটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এটাও আপনারা সবাই দেখেছেন এক পাশে কাত হয়েছিল ক্রেইনটি।
“চার নম্বরটি হচ্ছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য মতে- বিকালের দিকে রাস্তায় গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় এই গাড়িটি (দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ি) খুব দ্রুত নীচে চলে আসে, ক্রেইন অপারেটর হঠাৎ ব্রেক করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এটা প্রাথমিক অভজার্ভেশন।”
এ বিষয়ে ‘সঠিক তথ্য’ পেতে চালককে প্রয়োজন জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, “আমরা ড্রাইভারকে খোঁজার চেষ্টা করছি, যেখানে পাওয়া যায় গ্রেপ্তার করার জন্য বলেছি, কারণ তার কাছে সঠিক ঘটনাটি জানা যাবে।
তিনি জানান, ওই গার্ডারের ওজন ছিল ৭০ টন, আর ক্রেইনটি ৮০ টন বহনে সক্ষম। ওই ক্রেইন দিয়ে আগেও গার্ডার সরানোর কাজ হয়েছে। তাহলে কেন দুর্ঘটনা ঘটল, তা জানতে চালককে দরকার।
কারা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, সে বিষয়েও তদন্ত কমিটি ধারণা দিয়েছে জানিয়ে আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, “এই দুর্ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে পেয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনকে (সিজিজিসি)। এই ধরনের কাজ করলে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি আগের দিন একটি … প্ল্যান দেয়, যেহেতেু সে আগের দিন কনসালটেন্ট টিমকে জানায়নি, কোনো প্ল্যান পায়নি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেই কাজটি করেছে। কোনো সাব ডিলারও নিয়োগ করেনি।
“নিজে চায়নিজ লোকদের নিয়ে ড্রাইভার দিয়ে কাজটি করেছে। সে ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি আমরা পেয়েছি। কারণ তাদের উচিৎ ছিল, প্রজেক্টের পিডি, পিএম, কনসালটেন্টকে জানানো। তারা কাউকে জানায়নি। তারপরেও উচিত ছিল যেহেতু কাজটা করবেই- তাহলে কাউকে না বললেও ট্রাফিককে বলা, সেটাও করেনি; এটা ঠিকাদারের ব্যর্থতা। ... সর্বোপরি ক্রেইন অপারেটর, তারও ব্যর্থতা আছে।”
সোমবারের ঘটনার সঙ্গে কারা সংশ্লিষ্ট ছিল, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “কালকে যারা ছিল, সবাই চায়নিজ কোম্পানির লোক; শুধু ড্রাইভার ছিল বাঙালি।”
চালকের লাইসেন্স আছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, “এটা তাকে খুঁজে বের করি, আমাদের অ্যাপয়েন্টেড নাকি অন্য কোনো ড্রাইভার সেটা বের হবে।”
ঠিকাদার কোম্পানির বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এ প্রশ্নের উত্তরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, “ঠিকাদার কোম্পানিকে জরিমানা করা যায়, টার্মিনেট করা যায়, ঠিকাদার যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে, সেজন্য ব্ল্যাক লিস্টেড করা যায়- এগুলো ব্যবস্থা নেওয়ার উপায়। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা হবে।”
জরিমানা হলে সেই অংক কত হতে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এত বড় ধরনের ক্ষতির জরিমানা কত, সেটা নিরূপণ করা কঠিন। আমরা এটাও করতে পারি, আর যাতে বাংলাদেশে কোনো কাজ এই প্রতিষ্ঠান না করতে পারে।”
সচিব বলেন, “কতটি ক্রেইন লাগানো হবে, কতটুকু এলাকা ঘিরে রাখতে হবে, কতজন লোক লাগবে, এই কাজের সঙ্গে কে কে থাকবে- এগুলো কনসালটেন্টের সঙ্গে কথা বলে আসতে হয়। গতকাল সেটা না নিয়ে কাজটি করেছে। কোনো ধরনের সেইফটি মেজারস না নিয়েই কাজটি তারা গতকাল করেছে। এর জন্য আমরা প্রথমে তাকে (ঠিকাদার) ধরলাম, সে বলছে এটা রুটিন ওয়ার্ক।
“আমরা বলছি কোনোভাবেই এটা রুটিন ওয়ার্ক না, এত বড় একটি সেগমেন্ট সরাতে অবশ্যই কনসালটেন্টের মতামত নিতে হবে। সে এটা কেন করল না, এর কোনো সঠিক জবাব প্রাথমিকভাবে পাইনি। “
আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সচিব বলেন, “আগে যারা সিকিউরিটিতে ছিল, তাদের আমরা টার্মিনেট করেছি।”
এটাই সমাধান কি না- এমন প্রশ্নে নুরী বলেন, “আমি এখানে নতুন, আমি যতদূর জানি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, “কেউ দায় এড়াতে পারে না। এক দিনের মধ্যে একটা তদন্ত হয় না। অবশ্যই সুযোগ আছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
“এই ক্রেইন দিয়ে কিন্তু গার্ডার উপরে উঠাচ্ছিল না। এটা দিয়ে স্থানান্তর করতেছিল। আরেকজন ড্রাইভার আনার পরে ওই ক্রেন দিয়েই গার্ডার সরানো হয়েছে। রেগুলার একটি মামলা হয়েছে।“
এ প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হওয়ার কথা জানতে চাইলে সচিব বলেন, “চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর আমাদের এই প্রকল্পের শেষ দিন। “
শুধু ঠিকাদার কোম্পানিকে দায়ী করা হচ্ছে, প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, “এখানে প্রজেক্টের পিডি, সুপারভারইজার- প্রত্যেককে আমি লিখিত শোকজ করব, কার কোনো জায়গায় ব্যর্থতা আছে তার ব্যাখ্যা চাইব।
“আর তদন্ত কমিটি আগামী দুই দিনের মধ্যে আমাকে (চূড়ান্ত) রিপোর্টটা দিবে। দায় দায়িত্বটা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেই নিয়েছে, কারণ কাল (সোমবার) কাজ করার কোনো কথা ছিল না।”