অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল প্রত্যাহার, মজুরি বৃদ্ধির দাবি মে দিবসে

আগামী ১৩ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সারাদেশে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে ১২টি সংগঠনের মোর্চা শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2023, 11:35 AM
Updated : 1 May 2023, 11:35 AM

শ্রমিকের দিন মে দিবসে শ্রমিক সংগঠনের জোটবদ্ধ অবস্থান থেকে ন্যায্য অধিকারের দাবি ওঠেছে; ন্যুনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার পাশাপাশি অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে দিয়ে সংসদে তোলা বিল প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

সোমবার সকাল থেকে মাথায় লাল পট্টি, হাতে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন, আর গায়ে নিজ নিজ শ্রমিক সংগঠনের টিশার্ট জড়িয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শ্রমিকরা জড়ো হতে শুরু করেন।

সেখানে অবস্থান ও বক্তব্যের পর বেলা ১১টার দিকে মিছিল যায় পল্টন মোড়ে। মিছিলের স্রোত গিয়ে মেলে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সম্মেলনে। সেখানে একে একে মিছিল নিয়ে যোগ দেন স্কপের ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা।

জোটের যুগ্ম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের হাওলাদার সমাবেশে এবারের মে দিবসের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সেখানে বলা হয়, ১৩৭ বছর পর এবারের মে দিবস শ্রমজীবীদের সামনে আরও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

কাদের হাওলাদার বলেন, সরকারের ন্যূনতম মজুরি ঘোষিত সেক্টরগুলোর মধ্যে কোনো কোনো সেক্টরে মজুরি নির্ধারণ হলেও তা বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; আর এর বাস্তবায়নে ধীরগতি শ্রমিকদের অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে।

“শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বোচ্চ উপায় হিসাবে ধর্মঘট করার অধিকারও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইনের খড়গের নিচে আটকে রাখার চেষ্টা চলছে। ইপিজেড, ইসিজেডসহ নতুন গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় আইনি বাধা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে না। ফলে শ্রমিকরা সংখ্যায় বাড়লেও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।”

শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাঁচার মত মজুরি নির্ধারণের কথা উঠলেই শিল্প সংকট, বাজার সংকট, করোনাভাইরাসের অভিঘাত আর যুদ্ধ পরিস্থিতিকে সামনে আনা হচ্ছে। শোষণ-লুটপাট, নির্যাতন, কর্মহীনতা, বেকারত্ব, বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ‘সমাজের শোষক গোষ্ঠীর সৃষ্ট এবং পরিচালিতি’, সে কথা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।

ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রেখে সংসদে উত্থাপিত অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এই বিল আইনে পরিণত হলে তা মালিকদের সুরক্ষা এবং শ্রমিকদের ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তি প্রদানের হাতিয়ারে পরিণত হবে।

অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে দিয়ে গত ৬ এপ্রিল সংসদে একটি আইন করার প্রস্তাব ওঠে। আইনটি পাস হলে কোনো ব্যক্তি ‘বেআইনি’ ধর্মঘট করলে বা চলমান রাখলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পাশাপাশি সরকার প্রয়োজন মনে করলে জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠানে লকআউট ও লেঅফ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।

এসব বিধান রেখে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল– ২০২৩’ সংসদে উত্থাপন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) নেতা আহসান হাবিব বুলবুল সমাবেশে বলেন, শ্রম প্রতিমন্ত্রী একজন শ্রমিক নেত্রী ছিলেন। শ্রম নেত্রী হয়ে শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী বিল সংসদে উত্থাপন করা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ বলেন, “আমাদের দেশে সরকার বড়লোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের পক্ষে আছেন বলে বক্তব্য দেন। কিন্তু আইন যখন করেন তখন তা যায় শ্রমিকদের বিপক্ষে। আমরা এই মে দিবসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে আমরা সোচ্চার আছি, থাকব।"

স্কপের এসব দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল ২০২৩’ প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী ১৩ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সারাদেশে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।

একই দাবিতে ২৭ মে সব সেক্টরের শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিনিধি সভা হবে বলেও জানানো হয়।

এদিনের অনুষ্ঠানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমিয়ে কম আয়ের মানুষের জীবন সহজতর করার দাবি যেমন ছিল, তেমনি ১০ বছর আগে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিও উঠেছে।

দিনের শুরুতে ঢাকার প্রেস ক্লাব থেকে পল্টন মোড়ে শ্রমজীবী এই মানুষদের সমাবেশ থেকে অধিকার আদায়ের আওয়াজ ওঠে প্রবলভাবে।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘শ্রম যার দুনিয়া তার’, ‘মালিক পাবে শ্রমিক পাবে না - তা হবে না তা হবে না’, ‘বিজিএমইএর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মে দিবস শিখিয়ে গেছে - লড়াই করে বাঁচতে হবে’- এমন সব স্লোগান প্রকম্পিত হয় প্রেস ক্লাব থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত।

মিছিলে বহন করা ব্যানার-ফেস্টুনে বেতন ভাতা বৃদ্ধি, ‘২৪ ঘণ্টা’ ডিউটি থেকে মুক্তি, আইএলও কনভেনশন ১৮৯ এবং ১৯০ অনুস্বাক্ষর, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণসহ নানা দাবি লিখে আনেন তারা।

মিরপুর সাত নম্বর থেকে গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার ফেডারেশনের ব্যানারে এই সমাবেশে যোগ দেন সুইটি ও রেহানা আক্তার।

সুইটি বলেন, “আমাদের দাবি ২২ হাজার টাকা মজুরি। পোলাপান লেখাপড়া করাইতে পারি না, খাওয়াইতে পারি না।”

রেহানা বলেন, “আমাদের দাবি বেতন বাড়ানো। ১১ হাজার পাই। এই বেতনে এই বাজারে কিছু হয় না। বেতন দিতে হবে ২২ হাজার।”

মতিঝিলের একটি রেস্টুরেন্টে বেয়ারার কাজ করা হোসেন মোল্লা বলেন, “আমাদের রেস্টুরেন্টে আট ঘণ্টার হিসাব কখনও আট ঘণ্টা থাকে না। কাস্টমার থাকলে কাজ চলতেই থাকে। এই অত্যাচার থামাইতে হবে।”

সমাবেশে মিছিল নিয়ে যোগ দেয় ঢাকা মহানগরীর প্রাইভেট কার ও ট্যাক্সি ক্যাব ড্রাইভার্স ইউনিয়ন, জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ট্রাস্ট গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এছাড়াও শ্রমিক লীগ ও শ্রমিক দলের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি রাজনৈতিক অন্যান্য দলের শ্রমিক সংগঠনগুলোও নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল।

সমাবেশে যোগ দিয়ে অটেরিকশা চালকরা সড়ক পরিবহন আইনে তাদের জরিমানার বিষয়টি আলাদা করে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে।

তাদের ভাষ্যে, কোনো কারণে যে জরিমানা ধরা হয় তাতে সারা মাস গাড়ি চালিয়েও অর্ধাহার-অনাহারে থাকা হয়। ট্রাফিক সিস্টেমের দায়ে আমরা যানজটে পড়ি। ৯০০ টাকা জমা ধরে সরকার নির্ধারণ করেছিল। তার কোনো বাস্তবায়ন নাই। বিআরটিএ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু ‘নো পার্কিং’ মামলা দিয়ে চালকদের ঠিকই ‘নিপীড়ন’ করা হয়।

এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে জাসদ চত্বরে জাতীয় শ্রমিক জোট-বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে শ্রমিক সমাবেশ হয়। সমাবেশে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা-শিল্পাঞ্চল ও গার্মেন্টস শ্রমিক জোট, পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক জোট, বাংলাদেশ পরিবহন হকার্স জোট, নির্মাণ শ্রমিকজোটসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ক্রাফ ফেডারেশনের হাজারো শ্রমিক যোগ দেন।

তাতে অংশ নিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “যে কোনো পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের নিজস্ব দাবি আদায় এবং ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার লড়াই জারি রাখতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার শ্রমিকের মানবাধিকার। কোনো অজুহাতেই ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করা যাবে না।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এদিন ঢাকার পল্টন মোড়ে সমাবেশ ও পরে লাল পতাকা মিছিল করে।

দলের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল এই বিল পাশ হলে শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ হবে। শ্রমজীবী মানুষের ওপর শুধু শোষণ নয়, তার যতটুকু শ্রম অধিকার আছে তা দিনদিন খর্ব করার চেষ্টা করছে সরকার।

“স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ও পরিপূর্ণ শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন হয়নি। সব শ্রমিক এখনো নিয়োগপত্র পায় না। বেঁচে থাকতে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ শ্রমিকের কাজের নিশ্চয়তা নেই।”

এর বাইরে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে অবস্থান কর্মসূচি করেছে ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন বাংলাদেশ।