বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কেবল অনুপ্রাণিত করেনি, স্বাধীনতা এনে দিয়েছে: প্রধানমন্ত্রী

“এই ভাষণ শুধু বাঙালি বা আমাদের না, ইতিহাসে যে নেতারা ভাষণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেই ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2024, 11:47 AM
Updated : 7 March 2024, 11:47 AM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ জনগণকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে এবং তাদের স্বাধীনতাও এনে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের স্মরণে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান।

শেখ হাসিনা বলেন, “ইতিহাস লিখতে গেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আসবেই। জাতির পিতার নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল। ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ। জয় বাংলা নিষিদ্ধ। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে কখনো মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। এটা আজকে প্রমাণ পেয়েছে।

“৭ মার্চের ভাষণ আজ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। জয় বাংলা স্লোগান আজকে আমাদের জাতীয় স্লোগান। কাজেই ৭ মার্চ এই ভাষণ শুধু বাঙালি বা আমাদের না, ইতিহাসে যে নেতারা ভাষণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেই ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে।”

১৯৭১ সালের এই দিনেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সেই ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, “এই ভাষণ মানুষকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতিই দেয়নি, যুদ্ধে বিজয়ও এনে দিয়েছে। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় কথা।”

বাবার স্মৃতি স্মরণ করে আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে জাতির পিতার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ‘অত্যন্ত সুপরিকল্পিত’।

“বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর পরাধীন থাকা যাবে না। জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মুক্তি দিতে হবে। আর সেই চিন্তা থেকেই ধাপে ধাপে তিনি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। তারই একটি অংশ হচ্ছে ৭ মার্চ।

“জাতির পিতা মাসের পর মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। দেশের মানুষের কথা তিনি যখনই বলেছেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে। বাঙালিরা সরকার গঠন করবে এটা পাকিস্তানিরা কখনো মেনে নেয় না। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কিন্তু বলেছেন কী কী অবস্থা ছিল। যেহেতু নির্বাচনে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি, তার দাবি ছিল আমাদের এখানে সংসদ বসতে হবে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখানে বসবে, ঢাকায় বসবে। কিন্তু সেটি বাধা দিয়েছিল ইয়াহিয়া খান, ভুট্টে। এসবের প্রতিবাদে সারাদেশের মানুষ আন্দোলনে ফেটে পরে। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ওই সময়ে ৭ মার্চ তিনি জনসভা করার ঘোষণা দিলেন।”

সেই ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেই জনসভায় লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছিল। হাতে বাঁশের লাঠি, কারো হাতে নৌকার বৈঠা, সবকিছু নিয়ে মানুষ ছুটে এসেছিল। এই ভাষণ দেওয়ার আগে আমাদের অনেক জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবী লিখিত বক্তব্য নিয়ে আসেন, কেউ পরামর্শ দেন। তখনকার ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল হক খান, তারা এসে বলল কালকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেই হবে। না দিলে চলবে না। মানুষ সেটাই চায়। বঙ্গবন্ধু দুই নেতার হাতে দুই হাত রেখে বললেন, ‘সিরাজ, লিডার শুড লিড দ্য ল্যাড, ল্যাড শুড নট লিড দ্য লিডার।”

সেদিন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “পরের দিন মিটিং, সকাল থেকে বাড়িতে লোকজন ভরা। অনেকে অনেক পরামর্শ, লিখিত বক্তব্য নিয়ে আসেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘অনেকে অনেক কিছু বলবে। তোমার কারো কিছু শোনার দরকার নেই। এ দেশের মানুষের জন্য তুমি সারাজীবন সংগ্রাম করেছো। তুমি জানো কি বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, তুমি শুধু সেই কথা বলব ‘।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তখনকার পরিস্থিতিতে খবর এসেছিল আমাদের কাছে যে, পাকিস্তানি মিলিটারি সবকিছু নিয়ে তৈরি। এদিকে লাখো জনতা ছুটে এসেছে কী নির্দেশ দেবেন নেতা। একজন নেতার কী দায়িত্ব? এই মানুষগুলোকে তাদের আকাঙ্ক্ষার বাণী শোনানো এবং শত্রুপক্ষকে কীভাবে বিরত রাখা, ৭ মার্চের ভাষণে কিন্তু সেটি স্পষ্ট করেছিলেন। গেরিলাযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন।

“যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করতে বলেছিলেন। পাশাপাশি সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে বলেছিলেন। যে কথা বলার সে কথা কিন্তু বলা হয়ে গিয়েছিল। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ঐতিহাসিক বাণী।”

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “৭ মার্চের ভাষণ একটা মানুষকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, আজকে এই ভাষণটা শুধু আমাদের ভাষণ না, আন্তর্জাতিক মর্যাদাও পেয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।”

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মাত্র ৩ বছর ৭ মাসের মধ্যে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে যখন স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন স্বাধীনতাবিরোধীদের সহ্য হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তানিরা হত্যা করার সাহস পায়নি। কিন্তু যারা দিনভর আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করত, তাদের দেখলাম ঘাতকরূপে। শুধু ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রপতিকে করেনি, আমার মাকে হত্যা করেছে। ছোট তিন ভাই, চাচাসহ সবাইকে হত্যা করেছে।

“বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ এক কদমও এগোতে পারেনি। বাংলাদেশ ছিল স্থবির। আর্থ সামাজিক উন্নতি হয়নি, দেশের মানুষ ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতা দখলকারী মুষ্টিমেয় কিছু লোক অর্থশালী হয়েছিল। কিন্তু দেশের মানুষ বঞ্চিতই থেকে গিয়েছিল।”

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ ’গড়ে তোলার প্রত্যয়ের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।