পাহাড়ে বাঙালিদের নেওয়া হয় খারাপ উদ্দেশ্যে: বিচারপতি নিজামুল

“শান্তি চুক্তি নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মৌলিক কোনো বিভেদ নাই,” বলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2023, 04:34 PM
Updated : 8 April 2023, 04:34 PM

সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে বাঙালিদের পাহাড়ে নেওয়ার পেছনে ‘খারাপ উদ্দেশ্য’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম।

তিনি বলেছেন, “তাদেরকে কার জায়গায় বসানো হয়েছিল? পাহাড়িদের জায়গায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়িদের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে বাঙালিদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া।”

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীর দায় ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব মন্তব্য করেন বলে আয়োজক চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

নিজামুল হক বলেন, “পার্বত্য চুক্তিতে চারটি খণ্ড ও ৭২টি ধারা। এই ২৫ বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? সরকার বলছে, এই চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়ন হয়েছে।

“অপরদিকে জনসংহতি সমিতি বলছে, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। কাজেই এই দুই বক্তব্যের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।”

পাহাড়ের সব মানুষ শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন চায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পার্বত্য চুক্তির (ক) খণ্ডের চার ধারায় বলা হয়েছে যে, চুক্তি বলবৎ হওয়ার তারিখ হতে এই চুক্তি অনুযায়ী উভয়পক্ষ হতে সম্পাদনীয় সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকবে। কাজেই এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যেহেতু এখনও বাস্তবায়িত হয় নাই, কাজেই এই চুক্তি এখনও বলবৎ আছে।

“পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। এই চুক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মৌলিক কোনো বিভেদ নাই।”

সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “আমরা যে এটাকে শান্তি চুক্তি বলেছি, তার মানে এর আগে একটা অশান্তি ছিল। কেন অশান্তি ছিল? কারণ তৎকালীন সরকার পাহাড়ে বাঙালিদের মেজরিটি বানিয়ে সেখানে পাহাড়িদেরকে প্রান্তিক করে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সংঘাত বাধিয়ে দেওয়া। এই সংঘাত থেকে মুক্তির জন্য যে চুক্তি হয়েছিল তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।”

পাহাড়ে সংঘাত বন্ধে তিনি ছয়টি সুপারিশের কথা তুলে ধরে জানান, যেগুলোর মধ্যে আছে গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু নির্বাচন করে প্রকৃত প্রতিনিধিদের বের করে আনা; পার্বত্য এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্পের সুষম বিকাশ নিশ্চিত করা; ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ সাধন; ভূমি মালিকানা ও ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ণ; ভারত প্রত্যাগত শারণার্থী ও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটা শুধু পাহাড়ের নয়। এটা একটা জাতীয় সমস্যা, এই সমস্যার নিষ্পত্তি রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। পাহাড় এখন ক্রমাগত ’৯৭ পূর্ববর্তী ধারায় ফিরে যাচ্ছে। তার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি এবং তার জন্য দেশবাসীকে সংগঠিত করতে হবে।”

বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, “জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যান আছে যে, পুরো পৃথিবীতে ৫ ভাগ আদিবাসী। এই ৫ ভাগ আদিবাসীই পুরো পৃথিবীর ৮০ ভাগ জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। কাজেই পুরো পৃথিবী রক্ষার জন্য এই আদিবাসীদেরকে রক্ষা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, “বলা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ‘উপজাতি’ অধ্যুষিত অঞ্চল হবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। কাজেই চুক্তি করে যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের মতবিনিময় সভা করে খুব একটা লাভ হবে না।”

তিনি বলেন, “পাহাড়ের মূল সমস্যা ভূমি। ভূমি কমিশন সভা ডাকলে হরতাল, অবরোধ ডাকা হয়। কাজেই বুঝতে হবে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে গেছে।”

ডাকসু’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন বলেন, “পাহাড়ে ভূমি হারানো আদিবাসীরা কেন তাদের জমি ফেরত পাবে না? সেখানে কেন পাহাড়িদেরকে উচ্ছেদ করে বাঙালিদেরকে প্রতিস্থাপন করা হবে? কুমিল্লার মানুষ যদি বরিশালের সমস্ত জায়গা কিনে নেয়, তখন কি বরিশালের মানুষ মেনে নেবে?”

আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র ও মেহনতি মন্তব্য করে সিপিবির কেন্দ্রীয় সদস্য দিবালোক সিংহ বলেন, “পাহাড়ে যেমন নিপীড়িত আদিবাসী আছে, তেমনি সমতলেও নানাভাবে বঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ আছে।

“এই সমস্ত মেহনতি ও দরিদ্র মানুষদের লড়াইয়ের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করতে হবে।”