ঢাকার উত্তরায় যেখানে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার স্থানান্তর হচ্ছিল ক্রেন দিয়ে, সেখানে নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
Published : 16 Aug 2022, 01:27 AM
ব্যস্ত সড়কের মাঝখানে ৫০ টন ওজনের গার্ডারটি ক্রেনে করে নিচ থেকে ট্র্রেইলরে তোলার সময় যখন শূন্যে ঝুলছিল, তখনও সেটির ঠিক নিচ দিয়ে কয়েকটি গাড়িকে দ্রুত পার হতে দেখা যায়।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উত্তরা অংশে ব্যস্ততম সড়কের মাঝে এ কাজের সময় ট্রেইলরের উল্টোপাশে কয়েকটি গাড়িও ছিল পার্ক করা। ট্রেইলর ও এসব গাড়ির মাঝখান দিয়েই চলছে যানবাহন।
সোমবার বিকালে বিশাল ওজন ও আকারের বক্সগার্ডারটি তোলার এসময়টাতেই হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ক্রেনটি কাত হয়ে যায়; গার্ডারটি ট্রেইলরে না বসে সেটি আছড়ে পড়ে একটি প্রাইভেট কারের ওপর।
পাশে ভবনের সিসিটিভি ফুটেজের দুর্ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পড়ার সময় গার্ডারের একটা অংশের ধাক্কাও লাগে ট্রেইলরে। তবে ব্যস্ততম এ সড়কে দিনের বেলায় বিশালকায় গার্ডার স্থানান্তরের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার সময় আশেপাশে ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী’র দেখা মেলেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ঘটনার পরপরই সেখানে উপস্থিত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানাতে পারেননি।
ঢাকা-ময়মনিসংহ মহাসড়কের উত্তরা অংশে জসিম উদ্দীন রোডের মাথায় প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে এ দুর্ঘটনায় গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যান দুই শিশু ও দুই নারীসহ পাঁচজন।
ওই পরিবারের আরও দুই সদস্যকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, মাত্র দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে তাদের।
চাপা পড়ে থাকার তিন ঘণ্টা পর গার্ডার সরিয়ে ও গাড়ি কেটে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থলে স্বজনদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
গাড়িতে থাকা আহত হৃদয়ের খালাতো ভাই মো. রাকিবের অভিযোগ, এত ব্যাপক আকারের উন্নয়ন প্রকল্প চলছে অথচ নিরাপত্তার কিছুই নাই। কোথায় সব বন্ধ করে দিয়ে এগুলো ওঠানামা হবে তা না নিচ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে দেদারসে।
দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ির পেছনের একটি মাইক্রোবাসে থাকা রাকিবের প্রশ্ন এমন ভারী নির্মাণের জিনিস সরানোর সময় কেন গাড়ি চলাচল করতে দিল?
তিনি বলেন, “নিরাপত্তা নেওয়া হলে এ দুর্ঘটনায় এত প্রাণহানি ঘটত না।“
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, দুর্ঘটনার পরপরই তারা ঘটনাস্থলে এসে প্রকল্প বা ঠিকাদারদের কাউকে পাননি। চাপা পড়া ব্যক্তিদের গাড়ি থেকে বের করতে তাৎক্ষণিকভাবে গার্ডার সরাতে সহযোগিতার জন্য কাউকে খুঁজেও পাননি।
ঘটনার পরই ক্রেন চালক বা এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সেখান থেকে সটকে পড়ে বলে জানান তিনি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নূরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবদিকদের বলেন, গার্ডার উত্তোলন করার সময় নিরাপত্তা বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কি না, ওই ক্রেনের সক্ষমতা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ওই এলাকার একটি ভবনের সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যায় রাস্তার মাঝখানে সারি দিয়ে রাখা বিআরটি প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছিল ট্রেইলারে। এর মধ্যে ভারসাম্য হারিয়ে ক্রেন একদিকে কাত হয়ে যায়।
তখন ক্রেনে থাকা গার্ডারটি ওই ট্রেইলারের পাশ দিয়ে টঙ্গীমুখী সড়কে চলমান প্রাইভেটকারটির ওপর পড়ে। ভারী ওই গার্ডারের চাপে মুহূর্তের মধ্যে চ্যাপ্টা হয়ে যায় গাড়িটি।
এসময় কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ওই ভিডিওতে দেখা যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যেই ক্রেনের পাশ দিয়ে নিয়মিত গাড়ি যাতায়াত করছিল।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক (আরএইচডি) ইলিয়াস শাহ সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এখানে এসেছি; কেন, কী কারণে ঘটেছে এমন মর্মান্তিক ঘটনা- সেটা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগবে।”
নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়েই গার্ডার ওঠানো নামানো হচ্ছিল দাবি করে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, “গার্ডারটি পড়েছিল নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে। সুতরাং এখানে ক্রেনের ত্রুটির কারণে না চালকের... তা তদন্ত কমিটিই বলবে। ৮০ টন ওজনের গার্ডার বহনের সক্ষমতা রয়েছে ক্রেনটির।”
সন্ধ্যায় ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ও সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ডটকমকে জানান, ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানোর সময় সবগুলো লেইন বন্ধ করে একটি লেইনে গাড়ি চলাচলের জন্য রাখা হয়। কিন্তু সেখানে গাড়ির চাপ বেশি থাকলে যে লেইনে গাড়ি চলার কথা না সেখানেও গাড়ি চলে যায়।
এর আগেও ‘নিরাপত্তার অভাবের’ বিষয়টি তারা ঠিকাদারকে প্রায়ই বলেছেন বলে তিনি জানান।
তার ভাষ্য, “তাদের যে সেইফটির অভাব আছে তা আমি সেদিনও মিটিংয়ে বলেছি। মন্ত্রণালয়ে আমাদের একটা রিভিউ মিটিং হয়েছে যেখানে এডিবির প্রতিনিধিও ছিলেন। সেখানে সেইফটি অডিট করার জন্য আমি মিটিংয়ে বলেছি। এটা নিয়ে গতকালও একটা মিটিং হয়েছে।”
এ প্রকল্পের নির্মাণ সরঞ্জামের ইয়ার্ড টঙ্গীর গাজীপুরে। সেখানে ‘প্রিকাস্ট সেগমেন্ট’ বক্সগার্ডারগুলো বানানোর পর সেগুলো উত্তরার ওই এলাকায় নির্মাণ সাইটে এনে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ট্রেইলরে করে গার্ডার নিয়ে পিয়ারের ওপর তোলা হয়।
সোমবারও একটি পিয়ারের ওপর তোলার জন্য গার্ডারটি ট্রেইলরের ওপর তোলা হচ্ছিল।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যে ক্রেন দিয়ে গার্ডার তোলা হচ্ছিল সেটি কোবেলকো-৭০৮০ মডেলের। ক্রেনটি ৮০ টন পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে। আর একেকটি গার্ডারের ওজন প্রায় ৫০ টন।
তবে ওই ক্রেনের অপারেটরের ভারি যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না বলে জানিয়েছেন বিআরটি প্রকল্পের আরেক কর্মকর্তা। হালকা মোটরযান চালনার লাইসেন্স দিয়েই ৮০ টন ওজন বহনকারী ক্রেন চালাচ্ছিল সে।
প্রকল্পের ওই অংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা এ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার অভিযোগ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদাসীন। এ প্রকল্পে এর আগেও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তা জোরদার করতে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
“আর যে চালক ক্রেনটি চালাচ্ছিল তার লাইসেন্সও ছিল না। হালকা যান চালানোর লাইসেন্স দিয়ে সে বিশালকায় ক্রেন চালাচ্ছিল।”
জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার অভাবই এমন দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করেন বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই দুর্ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ থেকে বিভিন্ন সময়ে এখানে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। তারপরও নিয়োগ দেওয়া আন্তর্জাতিক মানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোনো দায়ভার নিতে হয়নি। কোনো জবাবদিহিতার মধ্যেও তারা আসেননি।
“যে কোনো প্রকল্পে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ থাকে, কিন্তু বিআরটির প্রকল্পে ন্যূনতম কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানা হয় কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।”
ভারী নির্মাণ সামগ্রী স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা থাকতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ক্রেইন থেকে গার্ডার পড়ে যেতেই পারে, এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেন না ঘটে, সেই প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে নজরদারির যথেষ্ট অবহেলা ছিল বিধায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
“এখানে মূলত কার দোষ, সেটা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু যেহেতু আমরা দেখেছি ক্রেনটি একদিকে হেলে গিয়েছিল, এক্ষেত্রে যিনি এই ক্রেন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, তার অভিজ্ঞতা কতটুকু এবং তার যথাযথ লাইসেন্স আছে কি না, সেই বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা উচিত।”
বিআরটি প্রকল্পটিতে ‘শুরু থেকেই নানা অব্যবস্থাপনা ছিল’ মন্তব্য করে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এ কারণে প্রকল্পটি মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে আসছে।
দুর্ঘটনার পর রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই অর্থায়ন করতে অনেক সময় লেগেছে, প্রাক-সমীক্ষা দুর্বল ছিল। ঢাকা এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে প্রকল্পের বিষয়ে কোনো পরামর্শ না করায় তাদের কাছ থেকেও সহায়তা পায়নি।
তার ভাষ্য, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরিকল্পনা কমিশন জননিরাপত্তা এবং জনদুর্ভোগ মোকাবেলার জন্য আলাদা খরচ দেওয়ার পরও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নেওয়া হয়নি।
একটা গার্ডার পরিবহন করার সময় পাশের যানবাহন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এর মানে হল আগে একজন নিরাপত্তাকর্মী মারা গেছেন, একজন দোকানকর্মী আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাগুলোর কোনো শাস্তি হয়নি। ফলে তারা এত নির্লিপ্ত হয়েছে, এতটা অবহেলা করার সাহস করেছে। এই মৃত্যুটাকে আমি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বলব।”
গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় এ উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের দুটি অংশ।
মূল প্রকল্প গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত যেটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। আর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশ উত্তরা হাউজ বিল্ডিং হতে টঙ্গী চেরাগ আলী মার্কেট পর্যন্ত।
গাজীপুর ও টঙ্গী থেকে ঢাকায় যাওয়া ও আসার পথে যানজট কমাতে হাতে নেওয়া আলোচিত এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১২ সালে।
এতে সাড়ে কিলোমিটার এলিভেটেড ফ্লাইওভার ও সেতু থাকবে যার মধ্যে সাড়ে তিন কিলোমিটার হবে ৬ লেনের সড়ক এবং ১ কিলোমিটার হবে ২ লেনের।
এ সড়কে অবস্থিত টঙ্গী সেতু হবে ১০ লেনের এবং ওঠানামার জন্য ছয়টি এলিভেটেড স্টেশন থাকবে।