টার্মিনাল ছাপিয়ে সড়কের দুই লেইন দখল করে বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে মহাখালীতেও।
Published : 11 Apr 2024, 12:10 AM
কুমিল্লা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী তিশা পরিবহনের একটি বাস সায়েদাবাদ টার্মিনালে ঢোকার কথা সকাল ১০টায়। চালক তুহিন সরকার কাছাকাছি সময়ে টামিনালের মুখে এলেও জায়গা না থাকায় পুলিশ আবার তাকে ঘুরে আসতে বলে।
এভাবে পরপর তিনবার চেষ্টা করেও বাস রাখার জন্য টার্মিনালে ঢুকতে পারেননি এই চালক। সবশেষ চতুর্থবারের চেষ্টায় সফল হন তিনি। পরের ট্রিপের আগে বাস রেখে বিশ্রামে যেতে পারেন তিনি। কাউন্টারে যাত্রী হলে ডাকা হবে তাকে।
তুহিনের মতো আরও অনেক চালককে ঈদের আগের দিন সায়েদাবাদ জনপদ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী ঘোরাঘুরি করে সড়কেই থাকতে হয়েছে তিন ঘণ্টার উপর। একই অবস্থা বরিশাল থেকে আসা বেপারী পরিবহনের চালক রাকিব আহমেদেরও।
দক্ষিণের জেলা বরিশাল থেকে ভোর ৪টায় রওয়ানা দিয়ে ঢাকার পোস্তগোলা সেতুতে আসেন সকাল ৭টায়। সায়দাবাদ জনপদ থেকে যাত্রী নিয়ে ফের যাত্রাবাড়ী কাউন্টার হয়ে বরিশাল যাওয়ার কথা তার।
কিন্তু এই দুই কিলোমিটার পথ আসতেই সময় লেগেছে তিন ঘণ্টার বেশি। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুরপাল্লার বাস ঠাঁয় দাঁড়িয়ে, ধীর গতিতে চলে পুরো যাত্রাবাড়ী-সায়দাবাদ টার্মিনাল এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি করে। অথচ সড়কে যাত্রী নেই। অনেক বাসের কর্মীকে হাঁকডাক করে যাত্রী খুঁজতে দেখা যায়।
ফাঁকা শহরের অন্যত্র গাড়ির আনাগোনা কম হলেও টার্মিনাল ঘিরে এসব সড়কে বুধবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গাড়ির চাপ ছিল বেশ। ঢাকার এ মোড় থেকে বের হওয়ার পর দক্ষিণের জেলাগুলোতে যেতে সড়কে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বাস চালকদের।
চালক রাকিব আহমেদ বলছেন, শুধু পদ্মা সেতুতে টোল প্লাজায় গাড়ির একটু চাপ ছিল।
ঈদের আগের দিন বুধবার রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা, মাদারীপুর, বাগেরহাট ও যশোরের পথের অন্যতম রুট যাত্রাবাড়ী এলাকায় দেখা গেছে এমন চিত্র।
যাত্রী কমায় টার্মিনালে ঠাসাঠাসি বাস
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বাসগুলোর যান চলাচলের সুবিধায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দুটি র্যাম্প সরাসরি টার্মিনালে গিয়ে নেমেছে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার সময়ে টার্মিনাল থেকে এ র্যাম্পের একটি ব্যবহার করে ফ্লাইওভারে উঠতে পারে বাস।
ঢাকা-কুমিল্লা রুটে চলাচলকারি তিশা পরিবহনের চালক তুহিন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে টার্মিনালে নামতে চাইলে পুলিশ গাড়ি ঘুড়িয়ে যাত্রাবাড়ী পাঠিয়ে দেয়, বলে টার্মিনালে জায়গা নাই, ঘুইড়া আসো। পরে আবার আসলাম তখনও ঢুকতে দেয়নি। তিন তিনবার খালি চক্করই দিলাম। শেষমেষ চাইরবারের টাইমে ঢুকলাম।’’
এভাবে তাকে তিন ঘণ্টার মতো সড়কেই ঘোরাঘুরি করতে হয় বাস পার্কিং করতে। সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠিয়ে চলে না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘‘বাস টার্মিনালে থাকবে। যাত্রী পাইলে কল দিবে (ডাকা হবে)। তখন যাত্রী নিয়ে চলে যাব। এভাবে যতটা রাত যাত্রী, ততটা সময় গাড়ি থাকবে।’’
সায়দাবাদ টার্মিনালের হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক হাসান আহমেদ বলেন, ‘‘মঙ্গলবার সারা রাত মানুষ গেছে। চাপ ছিল সবচাইতে বেশি। আইজ মানুষ নাই। গাড়ি ভরতে সময় লাগে। সব গাড়ি টার্মিনালে। যাত্রী হইলে গাড়ি খবর দেই তারপরে ছাড়ি।’’
টার্মিনাল ছাপিয়ে সড়কের দুই লেইন দখল করে বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে মহাখালীতেও। এতে টার্মিনালের মুখে কিছুটা সময়ের জন্য লেগে যাচ্ছে যানজট।
ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি
শেষ দিনে যারা আগে থেকে টিকেট কেটে আসেননি তাদের হাতে সময় থাকায় অনেককে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি করতে দেখা গেছে।
অপেক্ষা করছেন যতটা কম ভাড়ায় যাওয়া যায়। এমনই একজন ফয়সাল আহমেদ, যিনি যাবেন পদ্মার ওপারের ভাঙা এলাকার পাচ্চর বাজারে।
তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ ভাড়া ১৫০ টাকা, আজ চাচ্ছে ৫০০ টাকা। দুইশ-আড়াইশ টাকা চাইলেও হয়। দেখি কখন কমে।’’
তার মতো অনেক যাত্রী অপেক্ষা করছেন। বিভিন্ন কাউন্টারে গিয়ে টিকেটের দরদাম করছেন। এক যাত্রীকে যাত্রাবাড়ী ইলিশ পরিবহনের টিকেট বিক্রেতা গোলাম রহমান টিটু সাফ বলে দিলেন, ‘‘গেলে যান, না গেলে নাই। এত কৈফিয়ত দিতে পারুম না। ভাড়া ফিক্সড, বরিশাল যাইতে ৮০০ টাকাই লাগব।’’
যাত্রী আনিছুর রহমান বলেন, ‘‘ঈদের সময়ে গাড়ি বেশি থাকে। তাই আগাম টিকিট কাটিনি। এখন ভাড়াও নিবে বেশি কিন্তু গাড়ি কখন ছাড়বে বলছে না। কাউন্টারওয়ালারা বলতেছে, গাড়ি আছে-আসব।’’
টিকেট বিক্রেতা গোলাম রহমান বলেন, ‘‘গাড়ি তো আছে। টিকেট বেচতে না পারলে গাড়ি তো কাউন্টারে আসব না। কতক্ষণ লাগে গাড়ি ভরতে তা তো জানি না। গতকাল ২০ মিনিট লাগছে আইজ দুই ঘণ্টাও লাগতাছে এক বাস যাত্রী পাইতে।’’
যাত্রাবাড়ী থেকে শরিয়তপুরগামী বাস ভাড়াও বেড়েছে। নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে ৩০০ টাকা বেশি চাচ্ছেন টিকেট বিক্রেতারা।
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী গুনগুন পরিবহনের বাস চালকের সহকারী শাহিন উদ্দিন বলেন, ‘‘সরকারি ভাড়া ৫৩৪ টাকা আসে। আমরা ৪০০ টাকা এমনকি ৩০০ টাকায়ও প্যাসেঞ্জার টানি। ঈদের সময় তো বরিশাল থেকে খালি গাড়ি আসে। তাই এবার ভাড়া সাড়ে ৭০০ টাকা।’’
ঢাকা-বরিশাল রুটে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চলাচলকারী বাস ইলিশ পরিবহনের যাত্রাবাড়ি কাউন্টার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘যাত্রীর চাপ অনেক কম। সকাল থেকেই কমছে। কালকেও ২০-২৫ মিনিট পর পর গাড়ি ছাড়তে পেরেছি। সেখানে বুধবার একটি বাসের টিকেট বিক্রি করতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগছে।
‘‘ঈদের সময় তো বরিশাল থেকে সময়মতো ঢাকায় বাস আনতে হয়, যাত্রী পাই আর না পাই। ড্রাইভার ও তেল খরচ আছে। শুধু ঢাকা থেকে যাওয়ার সময়ে যাত্রী হয়।’’
এ কারণে ঈদের সময়ে টিকেটের দাম একটু বেশি নিচ্ছেন বলে যুক্তি তাদের। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে এ পথে টিকেট বিক্রি করছেন ৯০০ টাকা, সাধারণ সময়ে যা ৬০০ টাকা। নন এসির টিকেট ৮০০ টাকা, সাধারণ সময়ে যা ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা।
জনপদ মোড়ে ইমাদ পরিবহনের টিকেটে কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ‘ফুড সাপ্লাই’ বিভাগের কর্মী আফজাল রহমান।
তাদের ঈদের ছুটি সবার শেষে হওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সকালেও অফিস করলাম। সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আজ বাড়ি যেতে পারব। পরিবার নিয়ে আসলাম।’’
কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে। ইমাদ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘গাড়ি আছে, সব টার্মিনালেই আছে। কিছু রাস্তায় আছে। যাত্রীর চাপ আজ নাই। যতোক্ষণ যাত্রী আছে ততক্ষণ গাড়ি ছাড়ব।’’
তিনি বলেন, দিনে যাত্রী কমলেও রাতে অনেক ব্যবসায়ী যেতে পারেন বাড়ি। তাদের জন্যর অপেক্ষা।
সাধারণ সময়ে রাত ১২টা পর্যন্ত বরিশাল-পটুয়াখালী রুটে বাস ছাড়েন তিনি। ঈদের আগের রাতে যাত্রী পেলে সারারাত বাস ছাড়ার প্রস্তুতি রয়েছে এ পরিবহনের।