বইমেলায় দেশের বিভিন্ন আদিবাসী সাহিত্যিকরা অচেনাই থেকে যাচ্ছেন। অন্য ভাষার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দিতে বাংলা একাডেমির উদ্যোগ চান অনেকেই।
Published : 19 Feb 2024, 10:50 PM
মণিপুরী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও লেখা প্রকাশ নিয়ে কাজ করা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'তিউড়ি' মণিপুরি ও বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত ১১৬টি বই প্রকাশ করেছে। ‘পৌরী’ নামের আরও একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেও ৪০টির বেশি মণিপুরী ভাষার বই প্রকাশ হয়েছে। মণিপুরী থিয়েটার থেকেও বেশ কিছু বই প্রকাশ হয়েছে। তবে এগুলোর কোনটিই অংশ নেয় না একুশে বইমেলায়।
অথচ মণিপুরীদের মূল উৎসব রাশমেলায় বইয়ের স্টল থাকে এ দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। ওই আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্যসব উৎসব বা মেলাতেও তাদের অংশগ্রহণ থাকে।
ঢাকা ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর মৈতৈ ভাষার বই প্রকাশ করে আসছে তিউড়ি। আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘পৌরী’ কাজ করছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে বিষ্ণুপিয়া মনিপুরী ভাষা নিয়ে।
এ দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যেমন একুশের মাসব্যাপী বইমেলায় আসছে না, তেমনি অন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষার বইও খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না মেলায়।
একইভাবে চাকমা, মারমা, গারো, মণিপুরী ভাষায় লেখা সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ প্রকাশেও খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না প্রকাশকদের। ফলে দেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকরা অচেনাই থেকে যাচ্ছেন বইমেলায়। আদিবাসী সাহিত্যিকদের যেসব বই মেলায় আসছে, তাও বাংলা ভাষায় লেখা। তাদের মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্যের বইগুলো দেখা যায় না একুশে বইমেলায়।
২০১৯ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ এর গেজেটে সরকার ৫০টি নৃ-গোষ্ঠীকে তালিকাভুক্ত করে। তাদের মধ্যে ৪১টি ভাষার ব্যবহার রয়েছে, এসব ভাষায় কেউ কেউ সাহিত্য চর্চাও করেন নিয়মিত। তবে মেলায় সেগুলো তেমন একটা পাওয়া যায় না।
প্রকাশকরা মনে করেন ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে সেসব বইয়ের বাজারে চাহিদা কম থাকার কারণেও তারা সেসব বই প্রকাশ করেন না। যারা প্রকাশ করছেন, তারাও মূলত আদিবাসী সাহিত্যিকদের মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্য নয়, বরং বাংলায় লেখা সাহিত্যকর্ম নিয়েই বই প্রকাশ করছেন।
একুশের চেতনাকে ধারণ করে আয়োজিত বইমেলায় যে কারণে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসী সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ খুব বেশি চোখে পড়ে না।
ছোটকাগজ দোলন এর সম্পাদক কামাল মোস্তফা বলেন, "ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে বাঙালি, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। ফলে এই দেশে আয়োজিত সবচেয়ে বড় বইমেলায় আদিবাসীদের অংশগ্রহণ না থাকাটা দু:খজনক।"
এমন প্রেক্ষাপটে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমিকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
আদিবাসী বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় স্টল বরাদ্দ ও প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু সেগুলো একুশের বইমেলায় পাওয়া যায় না।
“আমি মনে করি এই ব্যাপারটি মেলার আয়োজকদের ভাবা উচিত। আগামী বছর থেকেই একটি বিশেষ চত্বর বা প্যাভিলিয়ন রাখা উচিত, যেখানে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর সাহিত্য, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, লিটল ম্যাগের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির দায় রয়েছে। বাংলা একাডেমি উৎসাহ দিয়ে তাদের কীভাবে এই মেলায় যুক্ত করবে সেটা ভাবা উচিত।”
বাংলা একাডেমির ফেলো ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমি রয়েছে, তাদের মাধ্যমে কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রকাশনা সংস্থাগুলো যেন নিজেরাই মেলায় অংশ নিতে আসে, তার জন্য বাংলা একাডেমিকে চিন্তা করতে হবে। তারা অংশ নিলেই একুশে বইমেলা আরও বেশি বৈচিত্র্যময় এবং মেলার গৌরব বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করি।”
ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়ায় সাহিত্যচর্চা করেন শুভাশিস সিনহা। লেখালেখির জন্য তিনি পেয়েছেন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি সম্মাননা। নাট্যকার ও নির্দেশক হিসেবেও পরিচিতি তিনি।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় লেখা শুভাশিস সিনহার কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে- 'নুয়া করে চিনুরি মেয়েক', 'নঙমাঙ দিনর কবিতা', 'উদারি বানার দিনে'। গল্পগ্রন্থের মধ্যে আছে- ‘মানু কিদিয়া লেহাউশপাৎ লাল্লাম ইতারাতা' এবং মুক্তগদ্যের বই 'মরা মরা বেনিটিকর য়ারি'।
শুভাশিস সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মণিপুরী ভাষায় অনেকেই লেখালেখি করেন। তাদের লেখাও বাংলায় অনুবাদ হয়ে প্রকাশ হওয়া উচিত। অন্তত তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মণিপুরী ভাষার বই প্রকাশ করে। মণিপুরী থিয়েটারও কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে। এসব সাহিত্যকর্ম একুশে বইমেলায় কিন্তু দেখা যায় না।
বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে ‘থকবিরিম’ নামে একটি ছোট কাগজের স্টলে গিয়ে গারো ভাষার কয়েকজন সাহিত্যিকদের বই দেখা গেল। ‘থকবিরিম’ এবার নতুন সংখ্যা প্রকাশ না করলেও তারা আগের সংখ্যাগুলো সাজিয়ে বসেছে লিটলম্যাগ চত্বরে।
এছাড়া এবার মেলায় আদিবাসী ভাষার চারটি নতুন বই নিয়ে এসেছে বিদ্যানন্দ প্রকাশনী।
‘চাকমা ভাষায় রূপকথা’, ‘ম্রো ভাষায় রূপকথা’, ‘সাঁওতাল ভাষায় রূপকথা’ ও ‘মারমা ভাষায় রূপকথা’ শিরোনামে চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোতে বিভিন্ন গল্পকে ওই নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালে ইয়াঙ্গান ম্রোর লেখা ‘ম্রো রূপকথা’ ও ২০২০ সালে ‘ম্রো রূপকথা-২’ প্রকাশ করেছিল বিদ্যানন্দ।
যে দেশের মানুষ মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সেই দেশে যাতে সবার মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ তৈরি হয়, সেজন্য এসব বই রচনা করার কথা বলেন, বইগুলোর অনুলেখক মিজানুর রহমান সৈকত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে। কিন্তু ভাষাগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে আমাদের অনাথালয়ে যে শিশুরা থাকে, আমরা দেখেছি তারা তাদের ভাষা ভুলতে বসেছে। সেই কনসার্ন থেকে আমরা বইগুলো প্রকাশ করেছি।”
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বাঙালি যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে, একই প্রক্রিয়ায় কোনো নৃগোষ্ঠীর প্রকাশনা সংস্থাও মেলায় অংশ নিতে পারবে।”
তাদেরকে মেলায় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করার কোনো উদ্যোগ আছে কি না- এমন প্রশ্নে কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, “আলাদা করে কোনো উদ্যোগ নেই। তবে এবার মেলার পর কমিটির যে সভা হবে, সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করব। আমরাও চাই, তাদের অংশগ্রহণ মেলায় বাড়ুক।”
সোমবার ছিল বইমেলার ১৯তম দিন। মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। মেলা পরিচালনা কমিটির জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এদিন নতুন বই এসেছে ১১৫টি।
এদিন মেলার 'রিকশাচিত্র প্রদর্শন বই সংলাপ মঞ্চে' বিকাল সাড়ে ৫টায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সদ্যপ্রকাশিত কবিতা সংকলন মুজিবমঞ্জুষা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনিসহ অনেকে।
মূল মঞ্চ
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ: হাসান আজিজুল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোজাফ্ফর হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন করেন ফারুক মঈনউদ্দীন ও মহীবুল আজিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, দুলাল সরকার, মাসুদ আলম বাবুল, কাজী আনারকলি, বাপ্পী রহমান ও নাজমুল হুসাইন বিদ্যুৎ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আনজুমান আরা, বদরুল হুদা জেনু, মাহমুদুল হাকিম তানভীর, আওরঙ্গজেব আরু ও রূপশ্রী চক্রবর্তী।
এছাড়া শিল্পী ফরিদা পারভীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অচিন পাখি’, রাখাল কিশোর ঠাকুরের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ত্রিবেণী’ এবং আতিকুর রহমান উজ্জ্বলের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যাঙ্গন’ এর পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন আবিদা রহমান সেতু, সুমা রাণী রায়, ডালিয়া সুলতানা, আরিফ চৌধুরী পলাশ, মুন্নী কাদের, রোমানা আক্তার, জোহুরা আক্তার সোনিয়া ও মো. রেজাউল করিম। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন চন্দন দত্ত (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), এফ এম আলমগীর কবীর (বাঁশী) ও দীপঙ্কর রায় (অক্টোপ্যাড)।
মঙ্গলবার যা থাকবে
মঙ্গলবার বইমেলার বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ: জামাল নজরুল ইসলাম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আসিফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন সুব্রত বড়ুয়া ও আরশাদ মোমেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান।