একটি প্রকল্পের পরিচালকের কার্যালয় করতে গাবতলীতে জলাশয় ভরাট করছে বিএডিসি। অথচ আইনত এই জমি ভরাটের সুযোগ নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোশন চিঠি দিলেও থামছে না তারা।
Published : 10 May 2023, 12:33 AM
রাজধানীতে জলাশয় ভরাট করে সরকারি একটি সংস্থার স্থাপনা নির্মাণ ঠেকাতে না পেরে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশনের আপত্তি গায়ে না মেখে গাবতলী এলাকায় জলাধার ভরাট করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসি। সেখানে তারা একটি প্রকল্পের পরিচালকের জন্য কার্যালয় বানাতে চায়, যদিও আইন অনুযায়ী ওই জমি ভরাট করার সুযোগ নেই।
গাবতলীর গৈদারটেক এলাকার ওই জমি রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপে ‘জলাধার’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জমিতে কোনো স্থাপনা তৈরি করার সুযোগ নেই।
রাজধানীতে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউকের অনুমোদন নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটিও উপেক্ষা করছে বিএডিসি।
ওই জমিতে স্থাপনা তৈরির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গত ২৯ মার্চ বিএডিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছিল উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সে আপত্তি গায়ে মাখেনি বিএডিসি।
নগর কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, ওই এলাকায় জলাশয়টি ভরাট হলে তার প্রভাবে মিরপুর ও গাবতলীয় এলাকায় বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা বেড়ে যাবে।
শুরুতে বালু দিয়ে জায়গাটি ভরাট করা হয়েছিল। শনিবার গৈদারটেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখন বালুর ওপর এঁটেল মাটি ফেলা হচ্ছে। প্রতি রাতে ট্রাকে করে মাটি এনে ফেলা হয় এখানে। মাটি সরানো, সমান করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এক্সক্যাভেটর।
সেখানে একটি সাইনবোর্ডও টানিয়েছে বিএডিসি। তাতে লেখা, জীব প্রযুক্তি প্রকল্পের পরিচালকের কার্যালয় হবে সেখানে। এজন্য ভূমি উন্নয়ন কাজ চলছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যারিজ অ্যান্ড আনাস এন্টারপ্রাইজ এই মাটি ভরাটের এই কাজ করছে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজউক এলাকায় যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণে রাউজকের অনুমতির প্রয়োজন থাকলেও অনেক সরকারি সংস্থা তা মানে না। জলাধার ভরাট করাও আরেকটি আইনের বরখেলাপ।
“সিটি করপোরেশন বিষয়টি আমলে নিয়ে জলাধার ভরাট বন্ধে একটা চিঠি দিয়েছে। কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব ছিল এই কাজে বাধা দেওয়া। তবে অনুমতি নিয়েও যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা যাবে না। এতে আইন এবং নগর পরিকল্পনা দুটোরই ব্যত্যয় হচ্ছে।”
তিনি বলেন, ঢাকায় জলাধারের পরিমাণ এমনিতেই কম। তারওপর জলাধারগুলো ভরাট করে ফেললে পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
“এটা ভরাটের মাধ্যমে ঢাকার একটা বড় অংশের পানি যে এখানে এসে জমা হবে সেই জায়গাটা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে জলাবদ্ধতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রাজধানীতে উষ্ণায়ন বেড়ে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের ধারা আরও ত্বরান্বিত করবে।”
নিষিদ্ধ হলেও জলাশয় ভরাট চলেছেই
চলতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতেই অসহনীয় গরম থাকায় রাজধানীতে সবুজ ও জশালয় কমে আসার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
চার বছর আগে স্থপতিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর এক জরিপে দেখা যায়, নগরে জলাশয় ও খোলা জায়গার পরিমাণ কমে এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি ‘আদর্শ শহর’ গড়ে ওঠে কংক্রিট, সবুজ ও পানির সমন্বয়ে। অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলাধার থাকতে হবে। বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কংক্রিট এলাকা হতে পারে, বাকিটা ভবনের মাঝখানে খালি জায়গা হিসেবে থাকবে।
কিন্তু ঢাকায় এখন মোট জমির ৮০ শতাংশের বেশি জায়গাজুড়ে কংক্রিট, ৯ শতাংশের কিছু বেশি এলাকায় সবুজ আচ্ছাদন টিকে আছে। খোলা জায়গা এবং জলাভূমি আছে পাঁচ শতাংশেরও কম।
জরিপটি চালানো হয় ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। অথচ এই সময়ে ঢাকায় জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধে আইন করা হয়েছে।
২০০০ সালে সরকার জলাধার আইন করে, যার ৫ ধরায় বলা আছে, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। সেই জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করাও যাবে না৷
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও (২০১০ সালে সংশোধিত), যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
অথচ দুই দশকে জলাশয় ভরাট হয়েছে ১৩ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ।
এই যে খোলা জায়গা ভরাট হয়েছে, সেজন্য কাউকে শাস্তি পেতে হয়েছে, এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। বরং সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করতে বনানীর কাকলী থেকে-বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের পশ্চিম পাশের জলাধার, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক এবং রেললাইনের মাঝখানের জলাধার ভরাট হয়েছে।
কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ও ভরাট করা হয়েছে জলাধার। তবে সেখানে একটি লেক রাখা হয়েছে।
কুড়িল বিশ্বরোড-জোয়ারসাহারার মাঝখানের নিচু জমি ভরাট করে পূর্বাচল প্রকল্পের একটি সাইট অফিস করা হয়েছে। উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টর এলাকাটিও একসময় বিস্তীর্ণ জলাধার ছিল।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমিন বাজার ল্যান্ডফিল, একই এলাকায় মধুমতি মডেল টাউন ও আমিনবাজার জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রও করা হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে।
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়র আতিকুল
বিএডিসির এই জলাশয় ভরাট ঠেকাতে যা যা করা সম্ভব তা করার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশন।
ঢাকার উত্তরাংশের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জায়গাটির মালিক সিটি করপোরেশন নয়। আমাদের জমি হলে আমরা সেখানে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু এখন পারছি না। তবে এই জলাধার ভরাট বন্ধে আমরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছি।
“আমাদের আইন শাখাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তারা যেন ওই নির্মাণকাজ বন্ধে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ চাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গেও দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা তাসনুভা নাশতারান মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জলাধার ভরাট বন্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন তারা। পাশাপাশি সে জায়গাটি যেন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, সে নির্দেশনা চেয়েও আবেদন করা হয়েছে।
বিএডিসি যা বলছে
বিএডিসির সেন্ট্রাল টিস্যু কালচার অ্যান্ড সিড হেলথ ল্যাবরেটরি স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক এবিএম গোলাম মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মাটি ভরাটের কাজ ৮০ শতাংশের বেশি হয়েছে। ভবন নির্মাণ কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলছে, আগামী জুনে এটি শুরু হবে। তারা মাটি ভরাটের কাজ বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশনা পাননি।
এই নিচু জমি ভরাট করার আগে রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে গোলাম মনসুর বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালেই এই প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে আন্তর্জাতিক মানের একটা ল্যাব হবে, এটি দেশের মানুষের উপকারে আসবে।”
প্রকল্প নেওয়ার সময় ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এই জলাধারের ভূমিকার বিষয়টি ভাবনায় ছিল কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সেখানে ১১৭ একর এক ফসলি জমি। ঢাকায় আমাদের খামার একটিই। ল্যাব করার জন্য ঢাকায় আর কোথাও জায়গা না থাকায় এই জমিতে করা হচ্ছে। ল্যাবের জন্য যে জমি নির্ধারণ করা হয়েছে এর সামনে দিয়ে পানি যাওয়ার বড় ড্রেন আছে। ড্রেন দিয়ে পানি নদীতে চলে যায়।”
এ বিষয়ে জানতে বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
যে কারণে শঙ্কা
ঢাকায় বৃষ্টির পানি ধারণের বড় জলাধার কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ড লাগোয়া ওই জমির মালিক বিএডিসি। তবে রেগুলেটিং পন্ড এবং লাগোয়া এসব নিচু জমিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানি এসে জমা হয়। সেখান থেকে পানি নিষ্কাশন করে ফেলা হয় তুরাগ নদে।
ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় রেগুলেটিং পন্ডের ৫৩ একর জমিও বুঝিয়ে দেয়। এছাড়া ওই বেড়িবাঁধের পাশে সংস্থাটির আরও ৫৩ একর জমি রয়েছে। সেখানে প্রায় ১১৭ একর জমির মালিক বিএডিসি।
গত কিছুদিনে ঢাকায় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের সময় পানি না পাওয়ায় আগুন নেভাতে গিয়ে বেগ পোহাতে হয় দমকল বাহিনীকে। এছাড়া বর্তমানে প্রচণ্ড গরমের সময় ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পেছনে জলাধার কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ মনে করা হয়।
আরও পড়ুন
জলাধার ভরাট করে বিএডিসির গবেষণাগার, ডিএনসিসির আপত্তি