সাইবার নিরাপত্তা আইনের আগে গত নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের আইনের খসড়াও প্রকাশ করা হয়নি।
Published : 08 Aug 2023, 09:42 PM
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল যে আইনটি, তা হল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন; ব্যাপক সমালোচিত আইনটির নাম বদলে নতুন আইন করছে সরকার, যার নাম দেওয়া হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন আইনের খসড়াটি নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আসছে।
তবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে গত বছর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন প্রণয়নের সময়ও খসড়া প্রকাশ করা হয়নি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই আইনটিও ছিল আলোচিত।
আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় খসড়া প্রকাশ হয় নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত নেওয়ার জন্য। অনেক সময় অংশীজনদের সঙ্গে আইনের খসড়া নিয়ে আলাদা বৈঠকও করে মন্ত্রণালয়।
এভাবে খসড়া প্রকাশে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ আইনের খসড়া কেন প্রকাশ করা হয় না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আইনের খসড়া প্রকাশের ‘ইতিবাচক চর্চা’ শুরু করা আওয়ামী লীগ সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে এলে তা ‘ভালো প্র্যাকটিস’ হবে না বলে মনে করছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
সাবেক সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও বলছেন, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে খসড়া প্রকাশ করা হলে বিতর্ক এড়িয়ে ঘাটতি পূরণের সুযোগ তৈরি হয়।
সাইবার নিরাপত্তা আইনটি সোমবার মন্ত্রিসভায় তুলেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। তাদের ওয়েবসাইটে খসড়াটি মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখা যায়নি।
খসড়া আইনটি কেন প্রকাশ করা হয়নি- জানতে ওই বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফোন করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার সকালে ও বিকালে আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে দুইবার ফোন করা হলে তার দপ্তরের এক কর্মকর্তা তা ধরে বলেন, প্রতিমন্ত্রী ‘ব্যস্ত’, পরে যোগাযোগ করবেন।
তবে পরে আর প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যোগাযোগ করা হয়নি।
বদলে যাচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কতটা বদলাচ্ছে?
সাইবার আইন: মানহানিতে কারাদণ্ড বাদ, শাস্তি হবে জরিমানা
সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিএসএর রূপান্তর না হয়: টিআইবি
কোনো আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের আগে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত দিতে ২০১৭ সালের ১৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (আইন) আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের একটি কমিটি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এরপর থেকে যে কোনো আইনের খসড়া প্রথমে এই কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি কোনো বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিলে সেগুলো পূরণের পর তা মন্ত্রিসভায় তোলা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটিতে না পাঠিয়ে সরাসরি মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলা হয়েছে। মন্ত্রিসভা বৈঠকের চার দিন আগে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অংশ নেওয়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কাছে মন্ত্রিসভার জন্য এজেন্ডাভুক্ত অন্য আইনের খসড়ার সঙ্গে ওই খসড়াটি পাঠানো হয়। এর বাইরে কেউ এই আইনের খসড়া দেখার সুযোগও পাননি।
আইনের খসড়া প্রকাশের সুবিধা তুলে ধরে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খসড়া প্রকাশ করা হলে জানতে পারে, কোনো রকমের ঘাটতি বা অসুবিধা আছে কি না? তাহলে একটা পয়েন্ট আউট করা যায়। আমার মনে হয় না কোনো খসড়া প্রকাশ করা যায় না।
“এমন কোনো গোপনীয় তথ্য, যেটা জনগণের কোনো কাজে আসবে না, তেমন হলে প্রকাশ না করতে পারে। নরমালি নাগরিকদের জানার অধিকার আছে, সেটা প্রকাশ করতে আপত্তি কোথায়, আমি তো বুঝতে পারছি না।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আইনের খসড়া প্রকাশ করার আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় কিছু খসড়া সরকার ‘ইচ্ছে করেই’ প্রকাশ করে না। কারণ সেসব খসড়া প্রকাশের পর থেকে বির্তক শুরু হলে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগে যাবে। ফলে ‘স্পর্শকাতর’ কিছু আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয় না।
ওই কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাতেগোনা কিছু আইনের খসড়া বাদে সব খসড়া প্রকাশ করা হচ্ছে।
“আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সেসব খসড়া প্রকাশ করা হয়নি, সেগুলো নিয়েই বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে,” বলেন তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতায় সরব ছিল সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো। এখন যে সাইবার নিরাপত্তা আইন হচ্ছে, খসড়া প্রকাশ না হওয়ায় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
মঙ্গলবার তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে যে আইন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে সম্পর্কে সাংবাদিক সমাজের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি, তাই সাংবাদিক সমাজ ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে।
“প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইনে সাংবাদিকদের বিষয়ে কী কী ধারা রয়েছে, তাও সাংবাদিক সমাজ বিস্তারিত জানতে পারেনি।”
শফিক আহমেদ বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে এখন যে সমালোচনা হচ্ছে, মন্ত্রিসভায় তোলার আগে খসড়া প্রকাশ করলে তা নিয়ে আলোচনা হত, তাতে সংশোধন করা যেত।
আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় খসড়া প্রকাশের রীতি আওয়ামী লীগ প্রবর্তন করার পর সেই ধারা রক্ষা করলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে সময়ের কথাটি বলছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে আমি বহুবার আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস হাই কমিশনারের অফিস থেকে একটি টেকনিক্যাল নোট পেয়েছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনসালটেন্টের রিপোর্ট আছে।
“এইসব কিছু করে তারপরে আমরা … আর কত আলাপ করব? এত আলাপ করতে গেলে তো আর আইন করা যাবে না, আলাপের মধ্যেই থাকতে হবে।”
‘সবাইকে সম্পৃক্ত করা উচিৎ’
সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া শুধু প্রকাশই নয়, এই আইন পাসের আগে নাগরিক সমাজ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি না, তাদের পাশাপাশি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকদের সম্পৃক্ত করে এই আইনটি করা উচিৎ। কারণ এটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আইন।
“ডিজিটাল সিরিউরিটি অ্যাক্টের মতো কালা কানুনকে পরিবর্তন করে নতুন আইন করা হচ্ছে। বাস্তবে যেন ওই আইনের প্রতিচ্ছবি না হয়, নতুন কালাকানুন না হয় সেটিকে নিশ্চিত করার জন্য আইনের খসড়া প্রকাশ করা উচিৎ এবং অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে এটি করা উচিৎ।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বেশিরভাগ আইনের খসড়া প্রকাশ করে মতামত নেওয়া হচ্ছে। এই ইতিবাচক চর্চা যারা প্রবর্তন করেছে, তারাই যদি এটা থেকে সরে আসে, এটা তো কোনো ভালো প্র্যাকটিস হল না।”