জাতীয় কবির জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা হোক: খিলখিল কাজী

“তিনি আমাদের জাতীয় কবি, তবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আমরা এখনো তাকে পৌঁছে দিতে পারিনি,” আক্ষেপ করে বলেন কবির নাতনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2023, 05:53 AM
Updated : 25 May 2023, 05:53 AM

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন কবির নাতনি খিলখিল কাজী। 

তিনি বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়, আমরা অনেকদিন ধরে বলে আসছি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনও ছুটি ঘোষণা করা হোক।” 

কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় কবির সমাধিতে ফুল দিতে এসে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। 

কবির নাতনি বলেন, “তিনি আমাদের জাতীয় কবি, তবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আমরা এখনো তাকে পৌঁছে দিতে পারিনি। জাতীয় কবির জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা করা হলে সর্বস্তরের মানুষ জানতে পারবে যে ছুটি পেলাম সেটা কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনের।

“তার যে লেখাগুলো, সেগুলো শুধু বাংলার মধ্যে রাখলে হবে না, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে সেগুলো পৃথিবীর মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।” 

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন কাছের স্বজনদের। আর্থিক অসচ্ছলতা তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল।

সব বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তার লেখনী। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’। 

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে জাতিসংঘের ‘বিশ্ব এতিহ্য’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে খিলখিল কাজী বলেন, ৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধেও মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, বঙ্গবন্ধুকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। 

“জাতিসংঘের কাছে আবেদন করছি, কবিতাটি হেরিটেজ করা হোক এবং পৃথিবীর বুকে হেরিটেজ করে কবিতাটি ছড়িয়ে দেওয়া হোক। তিনি মানুষকে নিয়ে লিখেছেন বলে আজও প্রাসঙ্গিক, তার কবিতা গান সাহিত্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে আজীবন করে যাবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানস সকালে সহকর্মীদের নিয়ে জাতীয় কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। 

পরে তিনি বলেন, “নজরুলের প্রথম যে কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা, সেটিরও শতবর্ষপূর্তি হচ্ছে। নজরুল তার জীবনের উৎকৃষ্ট সময়ে যে প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন, সেটাই তাকে সারা পৃথিবীতে মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে, সাম্যের কবি, ভালোবাসার কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি হিসেবে গভীরভাবে স্থাপন করেন।” 

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় কবির সমাধিতে ফুল দিতে এসে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “নজরুল প্রেমের কবি, বিদ্রোহ ও বেদনার কবি। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার বিচরণ রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি। এই চেতনায় আমরা উজ্জীবিত হতে চাই। 

“অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অন্তরায় সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, সাম্প্রদায়িকতা আজকে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ বাংলাদেশে বিস্তার করেছিল, তা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হয়েছে, আমাদের আরো লড়াই করতে হবে। সেটি আজকে আমাদের অঙ্গীকার, সেটাই হবে নজরুলের চেতনার প্রতীক।”

বিএনপির পক্ষ থেকে নজরুলের সমাধিতে ফুল দিতে এসে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, “নজরুল জীবদ্দশায় দেশের জন্যে, এই দেশের মানুষের জন্যে যেখানে অন্যায়, অত্যচার হয়েছে সেখানে বিদ্রোহ করেছেন, তার লেখনীতে তা ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্য তিনি যে অবদান রেখেছেন সেটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি

শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।

রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষণিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। 

১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।

একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।