১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট) ঢাকায় মারা যান কবি নজরুল। রেওয়াজ অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার তারিখ মেনে তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করে বাংলাদেশ।
Published : 27 Aug 2023, 11:29 AM
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
রোববার সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
সকাল পৌনে ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন। এরপর সমাধি প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল ৭ টার দিকে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কবির সমাধিতে যান। সেখানে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে এবং পরে দলের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা।
আওয়ামী লীগের পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলের নেতাকর্মীরা জাতীয় কবিকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল ইসলাম। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাকে বাংলাদেশে এনে নাগরিকত্ব ও জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র তিনি মারা যান।
কবির সমাধিতে ফুল দেওয়া শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “নজরুল চিরদিনই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। তিনি আগেও প্রাসঙ্গিক ছিলেন, এখনো তিনি বাঙালির জীবনে প্রাসঙ্গিক।
“জাতীয় কবি যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা, গানে চেতনার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সেই সাম্প্রদায়িকতা এখনো আমাদের এই স্বাধীন দেশে অগ্রগতির পথে, বিকাশের ধারায় অন্তরায় হয়ে আছে। তাই আজকের দিনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে সমূলে ধ্বংস করব এই শপথ করি এবং বাংলাদেশে যারা সত্যিকারের বাঙালি তাদের কাছেও এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।”
রুহুল কবির রিজভী বলেন, “আজকের দিনে অধিকার হারা, গণতন্ত্র হারা, মতপ্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতা হারা, ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে আমাদের প্রতিদিন অতিবাহিত হচ্ছে। সেখানে যেন আমাদের কাছে এখনো উদ্দীপনার এবং প্রেরণার স্থল হচ্ছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
“আমরা যখন মিছিল করি, তখন আমাদেরকে প্রেরণা জোগায় কাজী নজরুল ইসলাম, আমরা যখন স্লোগান দিই তখন আমাদের প্রেরণা জোগায় কাজী নজরুল ইসলাম, আমরা যখন কারাগারে যাই, তখন আমাদেনকে প্রেরণা জোগায় কাজী নজরুল ইসলাম।”
তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদের এক দুঃসময় এবং দুঃশাসনের মধ্যে আমরা বাস করছি। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের একটি অন্যতম প্রেরণা হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলাম। আজকে আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া বন্দি, দেশনায়ক তারেক রহমান দেশে আসতে পারছেন না। শুধুমাত্র গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার জন্য আজকে হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে বন্দি। গণতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান ধরার জন্য আজকে তারা বন্দি, তাদের নামে মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা।
“একটি স্বাধীন দেশ তো এমন হওয়ার কথা ছিল না, জোর করে এমন করা হয়েছে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এই দুঃসময় অতিক্রম করার জন্য, ঘোর দুর্দিন অতিক্রম করার জন্য আজকে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান আমাদেরকে প্রেরণা জোগায়, আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করে, আমাদের উজ্জীবিত করে। তিনি আজীবন এদেশের মানুষের কাছে সাম্যের কবি, দ্রোহের কবি একইসাথে প্রেমের কবি।”
সমাধিতে জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, নজরুল গবেষণা কেন্দ্র, নজরুল একাডেমি, কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, নজরুল চর্চা কেন্দ্র ‘বাঁশরী, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ কৃষকলীগ, ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, জাসাস, বঙ্গবন্ধু শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলসহ বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান।
প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি
শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।
রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষণিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।
একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।
নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।
সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।
নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।
১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে নজরুলকে সম্মানসূচক 'ডিলিট' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় নজরুলকে।
সে বছরই ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মানবতা ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের। জাতীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে।