ঘূর্ণিঝড় মোখা আসছে কখন, কতটা তীব্রতা নিয়ে

সাগরে প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠলেও উপকূলে আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিঝড়টির তীব্রতা কমে আসতে পারে; আর এর প্রভাবে প্রশমিত হবে তাপপ্রবাহ।

মঈনুল হক চৌধুরীশাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2023, 03:34 PM
Updated : 13 May 2023, 03:34 PM

ঘূর্ণিঝড় মোখা শক্তি বাড়িয়ে সাগর থেকে স্থলভাগের দিকে এগোচ্ছে। এর গতিপথ বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূল।

রোববার নাগাদ এই ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। ৮ নম্বর বিপদ সংকেত রয়েছে চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে।

কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলার উপকূলের কয়েক লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সবচেয়ে বিপদের মুখে থাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রায় ৮৫০০ মানুষকে ‘সুপার সাইক্লোন’ মোকাবেলায় সক্ষম ৩৭টি অবকাঠামোয় তোলা হয়েছে।

স্থলভাগে চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে সাগরের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা যায়নি।

Also Read: ঘূর্ণিঝড়ে কী করবেন

Also Read: ঘূর্ণিঝড়: কোন সংকেতে কী বোঝায়

Also Read: মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে ঘূর্ণিঝড় এসেছে বার বার

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, দুপুর ৩টা পর্যন্ত আগের ৬ ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ১৯ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছিল।

এর আগে মোখার গতি ছিল এর অর্ধেকে; স্থলভাগের যত কাছাকাছি হবে, এর গতি তত বাড়বে বলে আগেই আভাস দিয়ে আসছিলেন আবহাওয়াবিদরা।

উপকূলে আঘাত কখন?

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, একদিন বাদে অর্থাৎ রোববার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং উত্তর মিয়ানমার দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, রোববার দুপুরে মিয়ানমারের কাইয়ুউ এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড়টি।

তবে শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়া শুরু হবে বলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিস্তৃত উপকূলে মধ্যরাত থেকে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি দেখা দিতে পারে।

জয়েন্ট তাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, রোববার প্রথম প্রহরেই মোখার অগ্রভাগ উপকূলের কাছে পৌঁছে যাবে।

যার অর্থ তখন থেকে ঝড়ের ধাক্কা শুরু হবে, যা প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর পুরো ঝড় উপকূলে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত চলবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “শনিবার শেষ রাতের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ উপকূল স্পর্শ করবে; সা্ই‌ক্লোনের মোস্ট অব দ্য পার্ট অতিক্রমের সম্ভাবনা রোববার বিকালে।”

কতটা তীব্র হবে?

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ মোখাকে ‘চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে উপকূলে আঘাত হানার সময় এর তীব্রতা কিছুটা কমে যাবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়ার বুলেটিন অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি রোববার উপকূলে আঘাত হানার সময় এর কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ১৭০-১৮০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটারে উঠতে পারে।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগের আভাস, ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছবে সাগরে থাকা অবস্থায় শনিবার রাতের আগেই। তখন এর কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ২০০ থেকে ২১০ কিলোমিটার হবে, যা দমকা হাওয়ার আকারে ২৩০ কিলোমিটারে উঠতে পারে।

তবে রোববার ভোরের আগেই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ কমে আসবে। উপকূলে আঘাত হানার সময় তা আরও কমবে।

তবে জয়েন্ট তাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্য বলছে, উপকূলে আঘাত হানার ঠিক আগেও বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টায়ও ঝড়ে বাতাসের তীব্রতা থাকবে ২১২ কিলোমিটারের বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, “অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার তীব্রতা হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ দেখছি। ল্যান্ডে উঠার সময় বা উঠলে পরে দ্রুত কমে যায়। তখন হয়ত সিভিয়াল সাইক্লোন থাকতে পারে বা এর কম বেশি হতে পারে। বাতাসের গতি ১০০-১৫০ কিলোমিটার থাকতে পারে।”

এই ঘূর্ণিঝড় নিয়ে শনিবার দুপুরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেছিলেন, “এটি (মোখা) সিডরের মতোই শক্তিশালী।

“প্রায় সিডরের সমতুল্য গতিবেগ নিয়ে সে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। তবে পার্থক্য হলো সিডর বাংলাদেশের মাঝ বরাবর দিয়ে গিয়েছিল, মোখা পাশ দিয়ে যাচ্ছে।”

২০০৭ সালে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর। তাতে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তারপর আরও অনেক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের মানুষ দেখলেও তত ক্ষতি আর হয়নি।

তবে পরে জরুরিএক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এটি সুপার সাইক্লোন হতে পারে, আমরা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছি যে এটি সুপার সাইক্লোন হওয়ার শঙ্কা নেই।

“সুপার সাইক্লোন হতে হলে ২২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় গতিবেগ হতে হবে। এর মধ্যে এখন বাতাসের গতিবেগ আছে ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। এখন এটা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা সিভিয়ার সাইক্লোন।”

প্রভাব কতটা জুড়ে?

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার ব্যাস ৫০০ কিলোমিটারের বেশি হওয়ায় এর অগ্রভাগের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অনেক এলাকায়।

তবে সিডরের সঙ্গে মোখার তীব্রতার তুলনা করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মোখা দেশের শেষ সীমানা দিয়ে অতিক্রম করছে। এর অর্ধেক থাকবে মিয়নমারের দিকে, অর্ধেক আমাদের দিকে।

“সিডরের পুরো বডিই বাংলাদেশের উপর দিয়ে গেছে। সেটার ক্ষয়ক্ষতি পুরোটাই গেছে বাংলাদেশের উপর আর আর মোখায় বাংলাদেশের এরিয়াটাই কম হবে।”

বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরের জন্য ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. আসাদুর রহমান বলেন, রোববার সকাল থেকে ঝড়ো হাওয়া, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। দুপুর থেকে তাণ্ডব বাড়বে।

তিনি বলেন, “৫০০-৫৫০ কিলোমিটার ডায়ামিটারের এই সাইক্লোনে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

ঝড়ের প্রভাবে সিলেট অঞ্চল পর্যন্তও বৃষ্টিপাত হওয়ার আভাস দিয়ে আসাদুর বলেন, “এটা যখন আছড়ে তীরে পড়ে যাবে, এটার ক্লাউড মাস্ক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে, যার প্রভাব সিলেট পর্যন্ত চলে যাবে, তাই সেখানেও প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ার-ভূমিধসেরও শঙ্কা, কমাবে তাপপ্রবাহ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. আসাদুর রহমান বলেন, “একটানা আট ঘণ্টার বেশি প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের আশংকা থাকে। সেক্ষেত্রে প্রবল বৃষ্টিপাতের আশংকা বেশি আছে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় এলাকায়।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারি (৪৪-৮৮ মিমি) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিমির বেশি) বর্ষণ হতে পারে এবং অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমি ধস হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছাসে প্লাবিত হতে পারে।

এছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছাসে প্লাবিত হতে পারে।

ঝড়ের প্রভাবে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, বান্দরবান, খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলাসমূহের উপর দিয়ে মৃদু থেকে বয়ে যাওয়া মাঝারি ধরণের তাপ প্রবাহও প্রশমিত হতে পারে।