সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণ: নিহত বেড়ে ১৭, উদ্ধার অভিযান স্থগিত

“পিলারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে ভেতরে ঢুকে উদ্ধার কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2023, 05:37 PM
Updated : 7 March 2023, 05:37 PM

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৭ জন; ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় উদ্ধার অভিযান রাতের মত স্থগিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী মঙ্গলবার রাত ১১টার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিলারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে ভেতরে ঢুকে উদ্ধার কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই উদ্ধার অভিযান রাতের মত স্থগিত করা হয়েছে। আমরা কাল আবার দেখব।”  

মঙ্গলবার বিকালে নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ওই ভবনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের পাশাপাশি সামনে রাস্তায় থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও হতাহত হন।

বিস্ফোরণের পর থেকে শতাধিক মানুষকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।

বিস্ফোরণে ক্যাফে কুইন ভবনের প্রথম দুটি তলার ছাদ ধসে বেজমেন্টে পড়েছে। সে কারণে ভেতরে আরও কেউ আটকা পড়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হলেও তাদের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না উদ্ধারকর্মীরা। কীভাবে সেখানে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটল, সে বিষয়েও কিছু জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা,বিশেষজ্ঞরা তা তদন্ত করে দেখছেন।

ভয়াবহ বিস্ফোরণ

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সিদ্দিক বাজারের ওই ভবনে বিস্ফোরণের খবর পান বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে। প্রথমে ছয়টি ইউনিট সেখানে গেলেও পরে তা বেড়ে হয় ১১টি। ডিএমপির কাউন্টারিজম ইউনিটের বম ডিসপোজাল ইউনিট এবং সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের একটি দলও পরে তল্লাশিতে যোগ দেয়।

সাত তলা যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার নিচের দুটো তলায় স্যানিটারি সামগ্রী আর গৃহস্থালী সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। তার উপরে ছিল ক্যাফে কুইন নামের একটি খাবার হোটেল। সে কারণে ওই নামেই ভবনটি স্থানীয়রা চেনে।

বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ভবনের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাভার পরিবহনের একটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আকতার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবনহানি অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে এ ধরণের বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।”

পাশের সাকি প্লাজা নামের পাঁচ তলা ভবনের ওপরে চারটি ফ্লোরে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্থান শাখা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই সার্ভিস সেন্টার। বিস্ফোরণের ধাক্কায় কাচ ভেঙে ব্যাংকের অফিস কক্ষগুলোর পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

ভবনে বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তার কথা ভেবে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার, নয়াবাজার, নর্থ সাউথ রোড় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

নর্থ সাউথ রোড ও আশেপাশের সড়কে স্থানীয়রা ভিড় করলে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এতে উদ্ধার কাজেও বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাব পড়ে পুরান ঢাকাকে যুক্ত করে এমন সব সড়কে। তাতে গুলিস্তান, মতিঝিলসহ রমনা পর্যন্ত সড়কেও যানজট দেখা দেয়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের নিচের কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে তারা যেতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা এসেছেন। একটু ‘স্টেবল’ হলে নিচের দিকে অভিযান চালানো হবে।

সে সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিস্ফোরণ যখন ঘটে মার্কেট তখন খোলা ছিল; ক্রেতা, বিক্রেতা, কর্মচারীরা ছিলেন। কতজন ভেতরে আটকা পড়ে আছে তা তাদের জানা নেই। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন, তাদের সব যন্ত্রপাতি দিয়ে নিচতলা এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে।”

এর ঘণ্টা তিনেক পর ফায়ার সার্ভিস রাতের মত উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার কাছেই বিআরটিসির বাস কাউন্টার। ব্যস্ত ওই সড়কে যানবাহনের পাশাপাশি প্রচুর পথচারী ছিল সে সময়।

বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গেছেন ভবনের নিচতলার বাদশা ট্রেডিংয়ের শ্রমিক আনোয়ার হোসেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, দোকানের ম্যানেজার কথায় চা আনতে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ বিস্ফোরণে বিকট আওয়াজে তিনি চেতনা হারান।

বিস্ফোরণে আগে দোকানের ভেতরে অন্তত তিনজন ছিলেন এবং দোকানের বাইরে ছিলেন স্যানিটারি দোকানের ৭-৮ জন শ্রমিক। চেতনা ফেরার পর দোকানের বাইরে থাকা শ্রমিকদের হাসপাতালে নিতে দেখলেও ভেতরে থাকা মহাজন ও বাকিদের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান বাদশা।

ওই ভবনের সামনে রাস্তার ওপর ভ্যানে করে বেল বিক্রি করছিলেন দিলীপ দাস। বিস্ফোরণে তিনিও আহত হয়েছেন।

দিলীপ বলেন, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় আশপাশের এলাকা। পথচারীদের ওপর বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়তে দেখেছেন তিনি। বিস্ফোরণে তার এক ক্রেতাও আহত হয়েছেন।

স্থানীয় দোকানদার মোহাম্মদ বিজয় বলেন, “আসরের নামাজের সময় সবাই যখন জামাতে দাঁড়াইছে, তখনই বিস্ফোরণ; আওয়াজে প্রথমে ভাবছি বোমা বোধহয়। কয়েক মিনিট ধোঁয়ায় পুরা এলাকা ঢাকা ছিল।”

স্থানীয়রা জানান, ভবনটির মালিক মৃত রেজাউর রহমান। এখন তার তিন ছেলে সেটির দেখাশোনা করেন। এখানে একসময় ক্যাফে কুইন্স নামে একটি রেস্তোঁরা দিয়েছিলেন ভবন মালিক। সেই সুবাদে ভবন ও মার্কেটটি ক্যাফে কুইন্স স্যানেটারি মার্কেট নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। 

কেন বিস্ফোরণ

সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানা এবং ঢাকার মিরপুরে রোডে ভবনে বিস্ফোরণের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটল। সিদ্দিকবাজারে এতবড় বিস্ফোরণের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। 

বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, “বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করে দেখছেন বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা। আপনারা জানেন যে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করে বলতে পারবেন যে এটি নাশকতা না কোনো দুর্ঘটনা।”

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “দোকান মালিক সমিতির লোকজন বলেছেন, নিচে কোনো গ্যাসের লাইন নেই। তবে পানির রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে। কোথায় কী ঘটেছে তা তদন্ত করে আপনাদের পরে জানাব।”

রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাও রাতে  ঘটনাস্থলে আসেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে ভবনটির কোথাও লিকেজ ছিল। এ কারণে অনেক গ্যাস জমে থাকতে পারে। হয়ত তখন কেউ ম্যাচের কাঠি জ্বালানোর ফলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ফায়ারের কর্মকর্তারা এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু বলেনি।”

তিনি জানান, পুলিশ ও রাজউক কর্মকর্তারা ভবন মালিকের সাথে কথা বলেছেন। ভবনের ভেতর থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভেতরে থাকা মালামাল সরিয়ে নিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন।

হাসপাতালে আহাজারি

বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, এ পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী।

তারা হলেন, মমিনুল ইসলাম (৩৮), তার স্ত্রী নদী আক্তার, মোহাম্মদ সুমন (২১), মুনসুর হোসাইন (৪০), ইসহাক মৃধা (৩৫), মো. ইসমাইল হোসেন (৪২), মো. রাহাত (১৮) ও আলামিন (২৩), মাইনউদ্দিন (৫০), নাজমুল হোসেন (২৫), ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), আকৃত্তি বেগম (৭০), মো, ইদ্রিস মীর (৬০), হৃদয় (২০), নুরুল ইসলাম ভুইয়া (৫৫) ও মো. সিয়াম (১৯)। তাদের মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।

ঢাকা মেডিকেলে যারা ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন আজিম (১৫), নোমান (৩২), ফাইজু (১৫), আশিক (২৩), কাউছার (৩৭) সিয়াম (৫০), শাকিল (২৩), শহিদুল (৩৪), শাহিন ( ৪২),  ফয়সাল (২২),  লিটন (২৫), মো. হাসান (৩০), মোস্তফা (৩০) নাজির (৩০), নির্জর (২৮), খলিল (৪০), রুহুল আমিন (৩২), রশিদ (৫৪), শিবলী (৩৫),  হাসান ( ২০), তোফাজ্জল (৩০), সজীব (২৪), সুমি ( ১৮), রকেয়া (৫০), রিয়াজ (২০), জাহান (২৫), শাহ আলম ( ৩০), নূর আলম (১৮), জাহান আলী (২০), মজনু (২৮), সেলিনা (৩৬), মোস্তাফিজুর (১১), রাজিব (৪২), ফারদিন (২২), মিলন (২৬), নার্গিস (৩০), হুমায়ুন কবির (৪৮), সুমন (২১), তুষার (১৮), সাইফুল (২০), আলামিন (২৫), শহিদুল (৪৮), মশারফ (৫০), জাহান ( ১৯), আলাউদ্দিন (২৩), সুমন চক্রবর্তী (৪১), তুহিন (১০),  আলাউদ্দিন (২০), জয়নাল (৫০), মহাম্মদ ঈসমাইল ( ৪২), সুলাইমান ( ২৪) ও জামাল (৩৬)। এছাড়া আরও অন্তত ছয়জন ভর্তি আছেন, যাদের নাম জানা যায়নি।

আহতদের মধ্যে দগ্ধ আটজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। তাদের সবার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা।

ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইয়ুব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চারজনের শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি পুড়েছে। একজনের ৯৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।”

দেহের ৫৫ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়েও বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন রোগীরা। কারও শরীরের ১৫ শতাংশের বেশি আগুনে পুড়ে গেলে চিকিৎসকরা ওই রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হিসেবে বিবেচনা করেন।