ভোট দিচ্ছে গাজীপুর

বিএনপি নেতার ছেলে এবং বহিষ্কৃত সাবেক মেয়রের মায়ের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে নৌকার প্রার্থী ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে কিনা, তা দেখা যাবে ঢাকার লাগোয়া এই সিটির নির্বাচনে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকগাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2023, 02:00 AM
Updated : 25 May 2023, 02:00 AM

জাতীয় নির্বাচনের আট মাস আগে সিটি করপোরেশনের নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ভোট দিচ্ছে গাজীপুরের পৌনে ১২ লাখ ভোটার।

বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় নির্ধারিত সময়েই ৪৮০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, একটানা চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।

এ নির্বাচনের সহকারী রিটানিং কর্মকর্তা এ এইচ এম কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো সমস্যার খবর পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বেশ ভালো।”

দেশের সবচেয়ে বড় এ সিটি করপোরেশনে ভোট নেওয়া হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে। প্রতিটি কেন্দ্রে বসানো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঢাকা থেকে সরাসরি নজর রাখছে নির্বাচন কমিশন।

এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত ভোট হচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে। এই ভোটের মধ্য দিয়ে একজন নতুন মেয়রের পাশাপাশি ৫৭ জন কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরকে নির্বাচিত করবেন ভোটাররা।

১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটারের এ নির্বাচনে মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ৩৩২ জন।

বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করলেও মেয়র পদে ভোটের লড়াইয়ে আছেন বিএনপির একজন সাবেক মেয়র প্রার্থীর ভাতিজা। বহিষ্কৃত সাবেক মেয়রের প্রার্থিতা না টিকলেও মাকে ভোটের মাঠে নামিয়ে তিনি নির্বাচন জমিয়ে দিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক এক আমলাসহ মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন মোট আটজন। জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন কিনা তা দেখার অপেক্ষায় পুরো দেশ।

নির্বাচন কমিশনও বলছে, গাজীপুরের নির্বাচন ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’। দেশের মানুষ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। সেজন্য এ নির্বাচন ‘সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ’ করতে চায় কমিশন।

আর গাজীপুরে ভোটের রেশ খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ধরে রাখতে চাইবে ইসি, যে ভোটগুলো আগামী মাসেই হবে।

নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ভোটের আগের দিন বলেছেন, “আমাদের বার্তা স্পষ্ট-আমরা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করছি, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করায় আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং নির্বাচনে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা করলে কোনো ধরনের ছাড় নেই। আশা করছি আমরা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে যাচ্ছি।”

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম মনে করেন, বিএনপির বর্জনে এ সিটির নির্বাচন পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলেও ভোটে মানুষের অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার যেন ভালোভাবে হয় সেদিকে নজর থাকবে সবার।

তিনি বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন না হলে তার গ্রহণযোগ্যতা এমনিতেই কমে যায়। এরপরও অনিয়ম ও বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ইসির কঠোর পদেক্ষপ দৃশ্যমান হলে এবং ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারলে আমরা এটা ভোটারদের অংশগ্রহণমূলক বলতে পারব।”

সামনে জাতীয় নির্বাচন। কাজেই সিটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলেও ভালো নির্বাচন হলে কমিশন এক ধরনের স্বস্তিতে থাকবে বলেই আব্দুল আলীমের বিশ্বাস। 

গাজীপুর সিটি নির্বাচন ২০২৩

>> ভোটের সময়: বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত

>> ভোটার: ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। পুরুষ ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২; নারী ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬; হিজড়া ১৮ জন।

>> পদ: একজন মেয়র, ৫৭ জন কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর।

>> প্রার্থী: মেয়র প্রার্থী ৮ জন; কাউন্সিলর প্রার্থী ৩২৪ জন।

>> কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ৪৮০টি ভোট কেন্দ্রের ৩৪৯৭টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হবে

>> ভোটের মাধ্যম: পুরো সিটির সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে।

>> গণনা শেষে ফল ঘোষণা হবে বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে।

ত্রিমুখী লড়াই

বরাবর আওয়ামী লীগ-বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে এলেও রাজধানীর পাশে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের ভোট সামনে এনেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট।

ক্ষমতাসীন দলের আজমত উল্লা খান রয়েছে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যিনি দশ বছর আগেও ভোট করেছিলেন। ২০১৩ সালে বিএনপির প্রার্থীর কাছে লাখো ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন। ২০১৮ সালের ভোটে প্রার্থী না হলেও এবার ফেরার লড়াইয়ে নৌকার এ প্রার্থী।

বিএনপি এবার দলীয়ভাবে মাঠে নেই। তবে সরকার শাহনুর ইসলাম রনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, যার বাবা বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। চাচা হাসানউদ্দিন সরকার ২০১৮ সালের ভোটে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন, শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলমের কাছে।

বিতর্কিত বক্তব্যের জেরে জাহাঙ্গীরকে দলীয় পদ হারাতে হয়, মেয়াদপূর্তির আগেই হারাতে হয় মেয়র পদ। নির্বাচনের আগে দলের ক্ষমা পেলেও তিনি নির্বাচনে মনোয়ন পাননি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ তাকে আবারও বহিষ্কার করেছে। আর নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করেছে ঋণ খেলাপি কোম্পানির জামিনদার হওয়ার অভিযোগে।

জাহাঙ্গীরের একটি কৌশল অবশ্য কাজে লেগেছে। নিজের সঙ্গে মায়ের জন্যও স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। তার মা জায়েদা খাতুনের প্রার্থিতা টিকে যাওয়ায় তিনি এখন মেয়র পদের প্রার্থী।

এছাড়া সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির লাঙ্গল নিয়ে মেয়র পদের নির্বাচন করছেন সাবেক সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন। দলীয় প্রতীকে পাঁচজন এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর এ ভোটে শেষ পর্যন্ত ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথাই বলছে সবাই।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “গাজীপুরের নির্বাচনে মেয়র পদে মূলত তিন প্রার্থীর লড়াই হতে যাচ্ছে। একজনের ফেরার লড়াই, যিনি জেতার জন্যে প্রচেষ্টা নেবেন। আবার আরেকজন দল থেকে বহিস্কৃত, তারও মা ভোটে রয়েছেন। এটা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্যে একরকম চ্যালেঞ্জ। আরেকজন বিএনপি না করলেও তার বাবা-চাচা করেছেন। দলের কানেকশন থাকায় ভোটের লড়াইও এটা প্রভাব ফেলবে।”

মেয়র পদে যারা লড়ছেন

·         আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান (নৌকা)

·         জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙ্গল) 

·         গণফ্রন্ট্রের আতিকুল ইসলাম (মাছ)

·         ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান (হাত পাখা),

·         জাকের পার্টির মো. রাজু আহম্মেদ (গোলাপ ফুল)।

·         স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে জায়েদা খাতুন ‘টেবিল ঘড়ি; সরকার শাহনূর ইসলাম রনি ‘হাতি’এবং মো. হারুন-অর-রশীদ ‘ঘোড়া প্রতীক’ নিয়ে লড়ছেন।

প্রার্থীরা যা বলছেন

গাজীপুরে দুই-তৃতীয়াংশ ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রার্থীদের শঙ্কার মধ্যে সিসি ক্যামেরা কোথাও ত্রুটি বা বন্ধ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও কমিশনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হবে।

বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও কারিগরি ত্রুটি দ্রুত কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তারও সক্ষমতা এবার সিটি ভোটে দেখাতে হবে ইসিকে।

মেয়র পদে প্রধান তিন প্রার্থীর দুজনই ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ভোটের আগে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমতের আশা, আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি।

শতভাগ জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আজমত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে একটা নির্বাচনী উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজমান। সুতরাং আমি এখানে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।”

ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নৌকার প্রার্থী আগের দিন বলেছিলেন, “নির্বাচন অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। নির্বাচনে মানুষ তাদের মনের মতো প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার জন্য তারা উৎসুক হয়ে আছে।”

ভোট নিয়ে শঙ্কা থাকলেও জয়ের কথা বলেছেন হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী রনি সরকার। তিনি বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটা কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের অনুকূলে নেই। তারপরও আমরা ভোটারদের বলব আমরা মাঠে আছি, যদি পরিবেশ ঠিক থাকে আপনারা আসেন, ভোট দেন। এই একটা সুযোগ এসেছে।”

তিনি মঙ্গলবার বলেছিলেন, “আমাদের এজেন্ট দেওয়ার ব্যাপারে আমরা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। আমরা নিজেরাইতো এখন শঙ্কিত, নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, সেই ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি সন্দেহ প্রকাশ করছি।”

এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো এবং ইভিএমে আস্থার কথা জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয় তাহলে আমার কোনো অবজেকশন থাকবে না।”

টেবিল ঘড়ি প্রতীকে লড়ছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা। তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট জাহাঙ্গীর মঙ্গলবার বলেন, তাদের সমর্থক ও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

“আমরা নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। …মানুষ আমার মা জায়েদা খাতুনকে টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দিতে প্রস্তুত। যদি সবকিছু ভালো থাকে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার না করা হয়; তাহলে মা অবশ্যই জয় পাবেন।”

রিটার্নিং অফিসারের উদাত্ত আহ্বান

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ফরিদুল ইসলাম ভোটারদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে পছন্দের প্রতীক ও প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে ভোট প্রদান এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে পাঁচ স্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করে গাজীপুরকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বিশৃঙ্খলার ঘটনা নজরে এলে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবস্থা নেবেন।

“জেলা প্রশাসন, পুলিশসহ সব বাহিনী মিলে সিটি নির্বাচনকে সফল করার জন্য কাজ করছে। সবার সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা যেন গাজীপুরে মডেল নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারি।”

আর নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তার কথা জানিয়ে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেছেন, “নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারি সেটা নিশ্চিত করব… গাজীপুরসহ সারা বিশ্বের লোকজন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা যাতে একটি ভালো সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারি।”