“আমাদেরকে লাল শাক লাগাইতে শেখাতে হবে কেন? এমন প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেটা কাজে লাগবে,” বলেন তিনি।
Published : 14 Jun 2023, 08:37 PM
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেছেন, পাহাড়ের মানুষের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কেবল তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিলে হবে না, সেই দক্ষতা কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে, নিজেদের সম্পদ কাজে লাগানো শেখাতে হবে।
তার ভাষায়, “লাল শাক কেমন করে লাগাতে হয় কিংবা বাঙালি মেয়েরা শাক সবজি লাগাতে জানে না, এটা কোনো কথা হইল! আমাদেরকে লাল শাক লাগাইতে শেখাতে হবে কেন? এমন প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেটা কাজে লাগবে।”
বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে পাহাড়িদের জন্য একটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন মন্ত্রী বীর বাহাদুর। পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় ৯৮ হাজার মানুষের দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
'পার্টনারশিপ ফর রেজিলিয়েন্ট লাইভলিহুডস ইন সিএইচটি রিজিওন-পিআরএলসি’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের পাহাড়ের মানুষের সমস্যা হল, আমার যে সম্পদ আছে, আমরা এটাই বুঝি না। অসুখ করলে আমরা দৌড়ে যেয়ে আপেল কিনি। কিন্তু তোমার ঘরের সামনেই যে পেয়ারা আছে, তাদেরকে এটা বোঝাতে হবে। এই মুরগি ডিম কীভাবে পাড়বে বা লাল শাক কীভাবে লাগাবে, এগুলা তাদের কোনো কাজে লাগবে না।
“পাহাড়িরা সহজ-সরল। আমরা বুঝি না যে উন্নয়ন কীভাবে হয়। সেজন্য আপনি যদি আমাদের কাউকে টাকা দেন, সে সোজা গিয়ে কতগুলো শূকর কিনবে। কারণ সে জানে যে শূকর থেকে এতগুলো বাচ্চা হবে। কিন্তু ওর মাথায় এটা নাই যে এই শূকরগুলো কোথায় বিক্রি করবে। তাই শুধু ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ করলেই হবে না, প্রয়োগ কোথায় করবে, সেটা দেখিয়ে দিতে হবে, পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”
চার বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে তিন পার্বত্য জেলার আট উপজেলার অন্তত ২০ হাজার পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হবে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থাপনা ও পোলট্রি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তাদের। প্রশিক্ষণ শেষে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক বিভিন্ন সহায়তাও দেওয়া হবে।
মন্ত্রী বীর বাহাদুর এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অন্যান্য প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য-পুষ্টি, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান আছে। তাই আমাদেরকে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবতে হবে।”
এ সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৃক্ষনিধনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমান বলেন, “আজ অনেকে বলেন, সেগুন গাছ কাটতে হবে, এটা নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামের ওয়াটার লেভেল অনেক নিচে নেমে যাওয়ার জন্য দায়ী। কিন্তু শুধু পাহাড়ে না, সারা বাংলাদেশের ওয়াটার লেভেলই কিন্তু নিচে নেমে যাচ্ছে। উন্নয়ন হলে এটা হবেই।
“সেজন্য আমরা যদি এখন সেগুন গাছ কেটে আবার নতুন করে গাছ লাগাই, তাহলে ওয়াটার লেভেল আসলেই উপরে উঠবে কিনা, আমি জানি না। তাই গাছ কাটার আগে যথাযথভাবে গবেষণা হওয়া দরকার।”
সচিব তার বক্তব্যে পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের কথাও বলেন। তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন হলে সারা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নত হবে। ওখানের সমস্যা হল, মার্কেট লিংকেজ, ভ্যালু চেইনের অবস্থা খুব খারাপ। আর রিমোট এলাকার পণ্যের মূল্য তারা যথাযথভাবে পান না। আজ পাহাড়ে কফি, কাজুবাদামের ভালো চাষ হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, এই দুটি পণ্য আমাদের তৈরি পোশাকের বিকল্প হতে পারে।”
তার মতে, পিআরএলসি প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে গরিব মানুষদের জীবন-জীবিকা উন্নয়নে জলবায়ু সহনশীল কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সহায়তা, উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা, পানি সংকটে সহায়তা সহ বিভিন্ন কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে।
“এই প্রকল্পটা হল আমাদের অনেক শুরুর শুরু। এই সরকারের আমলে শান্তিচুক্তি হয়েছে, যেটা আমাদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে কাজ করার জন্য। শান্তিচুক্তিতে ৭৫টি দফা ছিল, সেগুলোর ৬৫ দফা বাস্তবায়ন করেছি। বাকিগুলোও আমরা একদিন না একদিন অর্জন করব। হয়ত সময় নেবে কিছুটা,” বলেন মশিউর।
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও হেড অব মিশন চার্লস হোয়াইটলি বলেন, “পিআরএলসি একটি সমন্বিত প্রকল্প যেখানে বাস্তবায়নকারী সংস্থা এমজেএফ, ইউএনডিপি, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা, কমিউনিটি একসাথে কাজ করবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমন্বয়ের বিকল্প নাই।”
এই প্রকল্পের উপকারভোগীদের ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে নারীদের, যা ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ বিষয়ে চার্লস হোয়াইটলির বক্তব্য, “প্রকল্পটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করবে। সারাদেশের মত পার্বত্য চট্টগ্রামে কৃষিতে নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।”
অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নিরুপা দেওয়ান নুয়েন বলেন, “এ প্রকল্প নারীদের ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা, সম্পদে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। তারা অর্থনৈতিকভাবে ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভূক্তিমূলক হবে। কৃষিতে উৎপাদন, আয় ও পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতাও বৃদ্ধি পাবে।”
ইউএনডিপির ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি ভ্যান নুয়েনও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।