‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে খাসি সম্প্রদায়ের ভূমি দখলের অভিযোগ

এতে তারা ‘তাদের জমিতে’ প্রাকৃতিক পানচাষে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2022, 06:28 PM
Updated : 26 Nov 2022, 06:28 PM

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ডুলুকছড়া পুঞ্জির খাসি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে তাদের ভূমি ‘দখলের’ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এতে তারা ‘তাদের জমিতে’ প্রাকৃতিক পানচাষে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে বলে ওই এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনের পর মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

শনিবার ঢাকার মোহাম্মদপুরে ওয়াইডব্লিউসিএ মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় তারা এমন উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।

এর আগে বুধ ও বৃহস্পতিবার ডুলুকছড়া পুঞ্জির খাসি সম্প্রদায়ের এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে নাগরিক সমাজের একটি দল।

সরকারের সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের নিয়ম ভেঙে বনবিভাগ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাহায্যে ওই অঞ্চলের খাসি জনগোষ্ঠীর বসবাসের এলাকায় জমি দখলসহ তাদের পানজুম কেটে উজাড় এবং তাদের নামেই ‘মিথ্যা মামলা’ করে তাদের হয়রানি করছে- সরেজমিন পরিদর্শনে এমন অভিজ্ঞতা নিয়েই ফিরেছেন বলে জানায় নাগরিক দলটি।

মতবিনিময় সভায় গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, “রাষ্ট্র তার বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বনে বসবাসকারী আদিবাসীদের সাথে বিরোধ তৈরি করে রাখছে। খাসি জনগোষ্ঠীর মানুষ যে পদ্ধতিতে পানচাষ করে, তা হতে পারত একটি ঐতিহ্যগত পদ্ধতি ও খাসি অধ্যুষিত এলাকা হতে পারত বিশেষ কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল।”

এ সময় আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিকসহ অন্যান্যদেরকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং নাগরিক মঞ্চের মাধ্যমে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরার আহ্বান জানান পাভেল।

সভায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, “ডুলুকছড়া পুঞ্জিতে ৫০টি খাসি পরিবার বংশ পরম্পরায় পানচাষসহ বিভিন্ন বনজ ও ফলদ চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পুঞ্জির এ জমি কাগজে-কলমে বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে। ওই জমির মালিকানা দাবি করে ১৯৯৯ সালে দেওয়ানি মামলা করে পুঞ্জিবাসী। ২০১০ সালে আপিল আদালতে পুঞ্জিবাসীর পক্ষে মালিকানা ঘোষিত হয়।

“কিন্তু বনবিভাগ দীর্ঘদিন ধরে ভূমিদস্যু ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাহায্যে আদিবাসীদের সেখান থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।”

নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন সবাইকে নিয়ে সমন্বিত একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি পুরো মৌলভীবাজার জেলায় কতগুলো খাসি পুঞ্জি আছে, তাদের কী কী সমস্যা- এসব বিষয় লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাসেমের অভিযোগ, “প্রশাসন ভূমি লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে বনবাসীদের গুরুত্ব না দিয়ে বন নিয়ে যারা মুনাফা লাভ করতে পারেন তাদেরকে গুরত্ব দেয়। ফলে তাদের আগ্রাসী মনোভাব, মুনাফার জন্য ট্যুরিজম সম্প্রসারিত করতে ভূমি দখলের দিকে নজর দেন।

“ভূমি দখলের জন্য বনবাসীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।”

তিনি খাসি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদকরণ রোধে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সমতলের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।

বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, “খাসি জনগোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় প্রাকৃতিকভাবে বন ব্যবস্থাপনা করছে। সেই বনকে টিকিয়ে রাখতে হলে বনের মালিকানা তাদের কাছে রাখা দরকার। সেই সাথে খাসি জনগোষ্ঠীকে মিথ্যা মামলার হয়রানি থেকে মুক্ত করতে হবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের- বাপা’র নির্বাহী কমিটির সদস্য ফাদার যোসেফ গমেজ বলেন, মৌলভীবাজার খাসি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের। বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করছে।“

সভায় খাসি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি আরপিলস মারলিয়া পুঞ্জিবাসীকে পাশে থাকার অনুরোধ করে বলেন, “বনবিভাগ বারবার মিথ্যা মামলা দিয়ে অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ দিচ্ছে। পুঞ্জিতে এমন হয়েছে বর্তমানে মামলার পেছনে টাকা খরচ করতে করতে সন্তানের শিক্ষার খরচ বহন করতে ব্যর্থ হয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী।“

তার আশঙ্কা, যেকোনো মুহূর্তে তাদের উচ্ছেদ ও পানজুম ধ্বংস করতে পারে বনবিভাগসহ স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। তিনি নিরাপত্তাহীনতার কথাও তুলে ধরেন।

কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী হেলেনা তালাংয়ের সঞ্চালনায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট- এএলআরডি‘র কর্মকর্তা কিশোর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক হিরণ মিত্র চাকমা, প্রকল্প ব্যবস্থাপক উজ্জ্বল আযীম বক্তব্য দেন।

উন্নয়ন সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিনিধি দলটি ওই এলাকা পরিদর্শন করে বলে সভায় জানানো হয়।