বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণাক্ততা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সুন্দরীর মত কয়েকটি প্রজাতির টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
Published : 17 Sep 2022, 01:30 AM
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন তার নাম পেয়েছে বিশাল অংশজুড়ে সুন্দরী গাছের আধিপত্যের কারণে; গত তিন দশকে নানা কারণে এ গাছের বিস্তৃতি কমে এসেছে; সেই সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত সহিংষ্ণু কাঁকড়া গাছের বিস্তার বাড়ার তথ্য এসেছে এক গবেষণায়।
১৯৮৮ থেকে ২০২২ সালের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে চাঁদপাই রেঞ্জে যেখানে সুন্দরী-গেওয়া গাছ জন্মাত প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর, তিন দশক পরে তা সাড়ে ১২ হাজার হেক্টরে নেমেছে।
এই সময়ের মধ্যে কাঁকড়া গাছ ১৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে প্রায় সোয়া দুই হাজার হেক্টর জায়গা দখল করে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে বাস্তুসংস্থানে এমন প্রভাব পড়ছে। সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সুন্দরীর মতো কয়েকটি প্রজাতিকে টিকে থাকার লড়াইয়ে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) বন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জিয়াউল ইসলাম এই গবেষণা করেছেন।
২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পযন্ত ‘ম্যাপিং চেইঞ্জেস ইন দ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ইকোসিস্টেম ইউজিং স্যাটেলাইট সেন্সর ডেটা’ শীর্ষক প্রকল্পের গবেষণায় ‘স্যাটেলাইট সেন্সর ডেটা’ বিশ্লেষণ করেছেন জিয়াউল ও তার সহকর্মীরা।
গবেষণায় চাঁদপাই রেঞ্জের উত্তর পূর্বাংশের ২৭২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার স্যাটেলাইট ছবি ও ডেটা ব্যবহার করে দেখা যায়, সেখানে কাঁকড়া গাছ দ্রুতই সুন্দরী গাছের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: আবারও সুরক্ষা দেবে সুন্দরবন?
বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ মিলিয়ে এর মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবচ্ছিন্ন জোয়ারধৌত এই ম্যানগ্রোভ বনের বেশিরভাগ অংশ (৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার) পড়েছে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায়। বাকিটা ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অংশে।
সুন্দরবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা এবং কাদা চর। এখানে প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীর আধিক্যের কারণেই সুন্দরবন নামকরণ করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সুন্দরবনের অধিকাংশ বৃক্ষের শ্বাসমূল ঊর্ধ্বমুখী। ফলে শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী ও গেওয়া ছাড়াও পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি রয়েছে।
১৯০৩ সালে স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার উদ্ভিদের ওপর লিখিত গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায়। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়।
বিজ্ঞানী মাহমুদুর রহমান জানান, গত ৩০ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে তাদের গবেষণায়। ১৯৮৮ সালের ল্যান্ডসেট ডেটা এবং ২০২২ সালের ডেটাসহ আরও কিছু ডেটা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। রিমোট সেন্সিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ বলছে, আগে কাঁকড়া গাছ কম ছিল, এখন বেড়ে গেছে।
“আমাদের গবেষণায় এই চেইঞ্জটা পেয়েছি। এটা কী ক্লাইমেট চেইঞ্জের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে, তা এখান থেকে বলা কঠিন। ইমেজের মধ্যে আগে সেখানে সুন্দরী ছিল, এখন হয়ত কাঁকড়া গাছ পেয়েছি। সুন্দরী গাছ রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-এটাও কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে।”
এই কর্মকর্তা জানান, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ২০০০, ২০১০ ও ২০২২ সালের ল্যান্ডসেট-৫, ল্যান্ডসেট-৭, ল্যান্ডসেট-৮ ইমেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে গবেষণায়। ২০০৪-২০০৫ সালের কুইকবার্ড-২ স্যাটেলাইট ইমেজ, ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ডভিউ-২ স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে।
“জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মধ্যে সু্ন্দরবনকেও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এখানকার বাস্তুসংস্থানে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে- তা পর্যবেক্ষণ করা এ গবেষণার একটি অংশ।”
সুন্দরী গাছ ধীরে ধীরে হলেও কমছে জানিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, “খুব তীব্রভাবে কমছে তা নয়, কিন্তু কমছে। সেখানে কাঁকড়া গাছের পরিমাণ বাড়ছে।… বনে ইকোসিস্টেমে এক ধরনের পরিবর্তন তো আসছে।”
সুন্দরী গাছ: সুন্দরবনের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Heritiera fomes। বনে জোয়ার প্লাবিত ও কম লবণাক্ত এলাকায় বেশি জন্মে। ১৫ থেকে ২৫ মিটার বা ৪৯ থেকে ৮২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এই গাছ। কাণ্ড সোজা, ডিম্বাকার পাতা, মূলতন্ত্রে শ্বাসমূল ও বদ্ধ শোষকমূল রয়েছে। ঘণ্টাকৃতি ফুল প্রায় ৫ মিলিমিটার চওড়া হয়ে থাকে। সুন্দরী গাছের শেকড় মাটি আঁকড়ে ধরে রেখে ক্ষয় রোধ এবং উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ রক্ষা করে। এই গাছের কাঠেরও উৎস। তবে প্রচুর পরিমাণ কাঠ সংগ্রহ ও ‘আগা মরা রোগের’ প্রকোপে সুন্দরী গাছ কমে যাচ্ছে। সুন্দরী গাছের ‘আগা-মরা রোগে’ আক্রান্ত হলে গাছের কান্ডের শীর্ষভাগে প্রথম লক্ষণ দেখা যায়। পরে তা গাছের নিম্নাংশেও দেখা যায়। লবণাক্ততা বৃদ্ধিও গাছের সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ।
কাঁকড়া গাছ: ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে লবণ সহিষ্ণু এই গাছ কাঁকড়া নামে পরিচিত, বৈজ্ঞানিক নাম Bruguiera gymnorhiza. সাধারণত সাত থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হলেও এটি ৩৫ মিটার পর্যন্তও বেড়ে ওঠে। সুন্দরবনের মতো লবণাক্ত ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে এই গাছ দেখা যায়। কাঠের অন্যতম উৎস এই গাছ মাটির স্থিতিশীলতা, উপকূল রক্ষা, বায়ুপ্রবাহ, মৌমাছি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের উৎস।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামানও এক গবেষণায় দেখেছেন, সুন্দরবনে লবণাক্ততার প্রভাব বাড়তে থাকায় কাঁকড়া গাছের বিস্তার বেড়েছে।
তিনি বলেন, “পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছে বলেই একটা গাছ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আরেকটা গাছ বেড়ে গেছে। ‘আগা মরা রোগে’ বেশ কিছুদিন ধরে মারা যাচ্ছিল সুন্দরী গাছ। ১৯৮০ সাল থেকে এটা দেখা যাচ্ছে সেখানে; তা প্রকট আকারও ধারণ করেছে।”
আর কাঁকড়া গাছ যে বাড়ছে, তা বিভাগের একটি গ্রুপের গবেষণাতেও এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কাঁকড়া গাছ লবণ সহিষ্ণু বলেই ভালো বাড়ছে। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের জন্য এটাও একটা হুমকি। তিন-চার দশক ধরে এর কোনো গ্রোথ নেই, কোনো না কোনো রোগবালাই ধরে ফেলছে। এ গাছটা মারা যাওয়ার ট্রেন্ডটাই হচ্ছে ওই পরিবেশে গাছটা আর উপযুক্ত না। নেচারেও চেইঞ্জ আনতে হবে- একটা মারা যাচ্ছে, আবার অন্যটা গ্রো করছে। ওপেন স্পেস থাকবে না।”
বেশি লবণাক্ত অংশে সুন্দরী গাছের টিকে থাকা কঠিন বলে জানান কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, “সুন্দরবন মানে এই না যে সব গাছগুলোই লবণসহিষ্ণু। সেজন্য বেশি লবণাক্ত অংশে সুন্দরী গাছ জন্ম নেয় না; যারা বেশি লবণ সহিষ্ণু হতে পারে, তারা টিকে থাকে।”
এই গবেষক বলছেন, লবণাক্ততা যেখানে বেশি, সেখানে জীববৈচিত্র্য ও গাছের সংখ্যা কম- এটা সারা পৃথিবীরই চিত্র। আর স্পারসোর স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণে যে তথ্য মিলেছে, তা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলে তিনি মনে করেন।
“সুন্দরী গাছের প্রাধান্যের কারণে সুন্দরবন হয়েছে। খুব বেশি যেখানে লবণাক্ত সেখানে সুন্দরী গাছ তেমন নেই। মাঝামাঝি অংশে গরান, গেওয়া ও কাঁকড়া গাছ হয়।
“সুন্দরী গাছ মিঠাপানি বেশি পছন্দ করে। মিঠা পানির প্রবাহ আগের তুলনায় যেহেতু কমে গেছে, বেশি মাত্রায় দেশের অভ্যন্তরে লবণাক্ততা ঢুকে পড়ছে। লোকালয়ের দিকে একবার লবণাক্ততা বেড়ে গেলে সেখানে কোনো ফসলও হয় না।”
কামরুজ্জামান বলেন, “সুন্দরবন থাকবে, কিন্তু কোনো না কোনো প্রজাতি হারাবে। মিঠাপানিতে বৈচিত্র্য বেশি। সুন্দরবনের মিঠাপানি অঞ্চলে গাছের পরিমাণ কমে গেছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে গাছের সাইজ, গ্রোথ কমে গেছে। গেওয়া, গরান ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।”
স্পারসোর বন বিভাগের ওই প্রকল্পে ছোট পরিসরে গবেষণা হলেও সার্বিকভাবে এ চিত্র সুন্দরবনের সবখানে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।