রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি আম গাছ এবং প্রায় ২০ একর বন কেটে দেওয়া হয়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।
Published : 27 Oct 2022, 10:42 PM
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ম্রো গ্রামবাসীর আমগাছ ও কলাগাছ কেটে বাগান নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কর্মীদের বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার বাসিন্দাদের অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি আম গাছ এবং প্রায় ২০ একর বন কেটে দেওয়া হয়েছে বলে কারবারি রেংয়েন ম্রো জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতিদিন কোম্পানির ভাড়া করা শ্রমিকরা এসে আমাদের বাগানগুলো কেটে দিচ্ছে। আজ সকালেও প্রায় ৬০ জন এসেছে, জঙ্গল পরিষ্কারের নামে ফসল নষ্ট করেছে। আমরা কিছু বলতেও পারছি না।”
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, লামার সরই ইউনিয়নে রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়া, লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া- এই তিন গ্রামের ৩৬টি পরিবারে প্রায় ২০০জন ম্রো এবং ত্রিপুরার বসবাস।
রেংয়েন ম্রোর অভিযোগ, গত ২২ অক্টোবর ‘রাবার কোম্পানির ভাড়াটে লোকজন’ ম্রো গ্রামবাসীর জঙ্গল কাটা শুরু করে।
জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়ার কারবারি জয়চন্দ্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভাড়াটে ভূমিদস্যুরা দীর্ঘদিন ধরেই আদিবাসীদের ৪০০ একর জুমের বাগান এবং ভূমি দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অবস্থায় ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর লোকজন উচ্ছেদের ভয়ে আছে।”
তিনি বলেন, এই ৪০০ একর ভূমিতে বংশ পরম্পরায় তারা জুম চাষ ও ফলের বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ২০১৯ সাল থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড রাবার প্লটের জন্য ১ হাজার ৬০০ একর জায়গা ইজারা নেওয়ার নাম করে জুম-চাষিদের এসব ভূমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
রেংয়েন ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাবার কোম্পানির লোকজন আমার প্রায় ৩০০টা কলা গাছ কেটে দেয়। ৬ সেপ্টেম্বর রাবার কোম্পানির শ্রমিকরা আমাদের পাড়ার কলাইয়া ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়ে পাড়াবাসীদের হত্যার চেষ্টা চালায়। এর আগে ১০ অগাস্ট রাবার কোম্পানির ভাড়াটে লোকজন রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর করে।”
একের পর এক আক্রমণের শিকার হয়ে গ্রামবাসী স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে বলে জানান তিনি।
রাবার কোম্পানি ও গ্রামবাসীদের বিরোধের জের ধরে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ওই জায়গায় উভয় পক্ষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তারপরও গত ২ অক্টোবর রাবার কোম্পানির লোকজন ওই জায়গায় জঙ্গল কাটে বলে অভিযোগ করছে গ্রামবাসী।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে লামার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ বলেন, তিনি এবং জেলা প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে ‘অবগত আছেন’।
“গত তিন চার মাস যাবতই বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। উভয়পক্ষকেই সমঝোতায় আসার জন্য বলা হয়েছে। রাবার ইন্ডাস্ট্রির অনুকূলে সরকার ওই কোম্পানিকে জায়গাটি বন্দোবস্ত ভূমি হিসেবে ইজারা দিয়েছে। এখানে পাহাড়িরা বংশ পরম্পরায় বসাবাস করে এলেও তাদের কাছে মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র নেই।
“রাবার কোম্পানি যেন কিছু জায়গা পাহাড়িদের চাষাবাদের জন্য ছেড়ে দেয়, এই মর্মে তাদেরকে বলা হয়েছিল, যাতে করে পাড়াবাসীরা শান্তিপূর্ণভাবে জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। পাশাপাশি ম্রো এবং ত্রিপুরা অধ্যুষিত তিন পাড়ার অধিবাসীদেরও সমঝোতার ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য বলা হয়েছিল। তারা সেই সিদ্ধান্ত এখনও জানাননি।”
পাড়াবাসীর অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটের ব্যবস্থাপক কামাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জায়গা আমাদের জন্য সরকার থেকেই বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে ভূমি দখলের প্রশ্নই আসে না।”
প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা বৃহত্তর স্বার্থে কিছুটা নমনীয় হয়েছি, কিন্তু এখনও চূড়ান্ত সমাধান হয়নি।”
প্রশাসনের জারি করা নিষেধাজ্ঞা অমান্য এবং পাড়াবাসীর জুমের গাছ নষ্টের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “আপনারা চাইলে এখানে এসে দেখতে পারেন। যেই জায়গার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আরও দূরে আমরা আমাদের নিজস্ব বাগানেই রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালাচ্ছি।”
তবে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসার অভিযোগ, রাবার ইন্ডাস্ট্রি নিজস্ব জায়গায় সংস্কারের যে কথা বলছে, তা সঠিক নয়। বরং তারা ম্রো এবং ত্রিপুরা পাড়াবাসীর জায়গা থেকে ‘ধীরে ধীরে জোর খাটিয়ে দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’ বলে তার অভিযোগ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দীপায়ন বলেন, “তারা (রাবার ইন্ডাস্ট্রি) যদি নিজেদের জায়গার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করে থাকেন, তাহলে সেখানে রাবার বাগান কোথায়? তারা তো ওই এলাকার মোট ১ হাজার ৬০০ একর জমি লিজ নিয়েছেন, তাও এখন থেকে প্রায় ২৫-২৬ বছর আগে। তারা যেখানে জঙ্গল পরিষ্কারের কথা বলছে, সেখানে তো কোন রাবার গাছই নেই।
“বস্তুত তারা ১ হাজার ৬০০ একরের অনেক বেশি জায়গা দখল করে নিয়ে বসে আছে এবং নিয়মিত এটা সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে,” বলেন আদিবাসী ফোরামের এই নেতা।