মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন লেখক-প্রকাশকরা।
Published : 19 Jan 2023, 08:52 PM
একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার মাধ্যমে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রকাশনা সংস্থা ‘আদর্শ’র সিইও মাহাবুব রাহমান।
তিনি বলেছেন, “যেখানে সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বাংলা একাডেমি কোন যুক্তিতে সংবিধানবিরোধী অবস্থান নেয়?"
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ প্রশ্ন তোলেন।
এবারের বইমেলার স্টল বরাদ্দের তালিকা গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি, যাতে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা স্থান পেলেও ‘আদর্শ’র নাম নেই।
লিখিত বক্তব্যে মাহাবুব রাহমান বলেন, “মেলা কমিটিতে থাকা একজন প্রকাশক প্রতিনিধি আমাকে জানিয়েছেন, আদর্শ থেকে প্রকাশিত তিনটি বই নিয়ে বাংলা একাডেমির আপত্তি রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’, ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ ও জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ বই দেখিয়ে আদর্শ কর্ণধার বলেন, এই তিন বইয়ের জন্যই স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি বলে বাংলা একাডেমির লোকজন মৌখিকভাবে জানিয়েছে।
গত মঙ্গলবার লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করেন, তাদের বইয়ের কারণে আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না বাংলা একাডেমি। ফাহাম বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বড় মেয়ে শামারুহ মির্জার স্বামী।
ওই তিন বইয়ে রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিপন্থি কোনো কিছু নেই বলে দাবি করেন আদর্শ সিইও মাহাবুব।
এই প্রকাশকের ভাষ্য, মেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য ফোনে তাকে বলেছেন, আদর্শর বইতে সরকারবিরোধী মত রয়েছে।
“আরেক ফোনে বাংলা একাডেমির ডিজি কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা,তিনিও আদর্শর লেখক, তিনি আমাকে বলেন যে, ‘দেখো, কোনো বইতে যদি কারও বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকে, তবে সেই সব বইকে তো আমরা মেলায় স্থান দিতে পারি না’।”
তালিকা প্রকাশের পর শুক্র ও শনিবার বাংলা একাডেমি বন্ধ থাকায় ১৫ জানুয়ারি সেখানে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে মাহাবুব বলেন, ফোনে কথা বলা মেলা কমিটির ওই সদস্যের কাছে গেলে তিনি অধস্তন কর্মকর্তার কাছে যেতে বলেন। তার অধস্তন কর্মকর্তা জানান, তার কাছে কোনো কাগজপত্র আসেনি।
“৩১ সদস্যবিশিষ্ট মেলা কমিটিতে থাকা ৪ জন প্রকাশক প্রতিনিধিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারাও আমাকে জানান যে, এ ব্যাপারে তারাও কিছুই জানেন না এবং কমিটির মিটিংয়েও আদর্শর স্টল বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তখন আমি এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলা একাডেমির ডিজিকে চিঠি দিয়ে আসি। সেই চিঠির কোনো উত্তর আমি পাইনি। গত ১৭ জানুয়ারি আরেকটি চিঠি দিই। সেই চিঠিরও অদ্যাবধি কোনো উত্তর পাইনি।”
আদর্শর বইমেলায় অংশগ্রহণ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’ মন্তব্য করে সংবাদ সম্মেলনে কথাসাহিত্যিক এহসান মাহমুদ বলেন, “এখানে আমরা দেখে আসছি- ভিন্নমতের মতামত প্রকাশে বা গ্রহণে ক্ষমতাসীনরা কতটা কঠোর হয়ে থাকে। বইমেলায় আদর্শর স্টল বরাদ্দ নিয়ে যা হচ্ছে তা এই প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা, কেবল পদ্ধতিটা ভিন্ন।
“বাংলা একাডেমি যা করছে, তা খুবই বাজে কৌশল হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের যে চেতনা- এই ঘটনা তার পরিপন্থি।”
‘আদর্শ’ থেকে এবারের বই মেলায় নিজের বই প্রকাশ হবে জানিয়ে এহসান বলেন, “আমি আজকে এখানে আদর্শ প্রকাশনার একজন লেখক হিসেবে উপস্থিত হয়েছি। এই প্রকাশনার সঙ্গে আমার মতো আরও প্রায় ৩০০ এর অধিক লেখক রয়েছেন। তাই আমি আশা করি, বাংলা একাডেমি এইসব লেখকদের বই মেলায় পাঠকদের সামনে তুলে ধরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না।”
প্রকাশক মাহাবুব রাহমান বলেন, “সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বাংলা একাডেমি এখন বলছে, আদর্শর বই বাংলা একাডেমির স্টল বরাদ্দের নীতিমালা পরিপন্থি। সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা গেছে, এই নীতিমালা মনগড়া ও পরিবর্তনশীল।
“প্রতি বছর একুশে বইমেলার প্রাক্কালে আয়োজক কমিটি নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করে, যার কোনো কপি লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক কাউকে দেওয়া হয় না। এই অদৃশ্য নীতিমালা মূলত লেখক-প্রকাশকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার কাজে ব্যবহৃত হয়, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।"
লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ‘আদর্শ’কে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে মাহাবুব বলেন, “আদর্শ মানে ৬ শতাধিক বই, ৩ শতাধিক লেখক এবং লাখ লাখ পাঠক। আদর্শ স্টল না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই ৩ শতাধিক লেখক এবং লাখ লাখ পাঠক। করোনার কারণে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ওপর কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
“এমন অবস্থায় অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ধারদেনা করে আদর্শ লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বই প্রেসে আটকে আছে, অনেকগুলো বই বাঁধাইখানায় আটকে আছে। বইগুলো নিয়ে আমরা এখন কী করব, সেই সিদ্ধান্তহীনতা ও চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছি।”
এর আগেও আদর্শর স্টল বন্ধ করা হয়েছিল উল্লেখ করে মাহাবুব বলেন, “২০১৯ সালে বাংলা একাডেমি যখন আদর্শর স্টল বন্ধ করেছিল, আপনারা (সাংবাদিক) আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেবল আপনাদের প্রবল সহযোগিতার কারণেই সে বছর বাংলা একাডেমি আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দিতে বাধ্য হয়।”
“প্রতি বছরই তারা বিভিন্ন অজুহাতে নানা প্রকাশনীকে হয়রানি করে। এর আগে মেলা চলাকালে স্টল বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। আমরা বাংলা একাডেমির এসব তৎপরতা বন্ধের দাবি জানাই,” বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন-
১. অমর একুশে বইমেলায় লেখক ও প্রকাশকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত রাখতে হবে।
২. অবিলম্বে আদর্শকে এর প্রাপ্যতা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দিতে হবে।
৩. আদর্শর যে ৩ বইয়ের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি আপত্তি জানিয়েছে, সেগুলো মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রির পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪. গ্রন্থমেলায় আদর্শসহ সকল প্রকাশক ও লেখকদের হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. অবিলম্বে একুশে গ্রন্থমেলার দায়িত্ব সকল প্রকাশকের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশক গিল্ডের হাতে তুলে দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে উপস্থিত হন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোনো প্রকাশনীকে যদি স্টল দেওয়া না হয়, তবে সেটা চিঠির মাধ্যমে বা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে জানালে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ হল না।
“আর ভিন্নমতের কোনো লেখার বই প্রকাশের জন্য একটা প্রকাশনীকে স্টল না দেওয়া স্বেচ্ছাচারী আচরণ। বাংলা একাডেমি এটা করতে পারে না। বাংলা একাডেমিকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা জানাতে হবে, কেন স্টল দেওয়া হচ্ছে না।”
এক প্রশ্নের জবাবে আদর্শের সিইও মাহাবুব রাহমান বলেন, “বাংলা একাডেমির কাছে বিগত চার বছর ধরেই আমি প্যাভিলয়ন বরাদ্দ চেয়েছি। এর আগে ৪ ইউনিটের স্টল নিয়েছি। এবার যদি আদর্শকে মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া না হয়, তবে আমি উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেব।”
কথাসাহিত্যিক বাকী বিল্লাহও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
আদর্শকে স্টল না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইমেলা পরিচালনা কমিটি আছে, এই কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কমিটির আগামী বৈঠকে যা সিদ্ধান্ত হবে, সেটা সবাইকে জানানো হবে।”
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদর্শকে স্টল দেওয়া- না দেওয়ার কোনো কথা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়নি। বইমেলা পরিচালনার জন্য একটা নীতিমালা আছে; সেই নীতিমালা মোতাবেক যদি কোনো বইয়ে রাষ্ট্রবিরোধী আপত্তিকর কিছু থাকে, তবে সেই বইটি মেলায় স্টলে রাখা যাবে না।”