কয়লা ও গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারও হোঁচট খাওয়ায় ঘাটতির মুখে লোড শেডিং করছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিতরণকারী সংস্থাগুলো।
Published : 18 Jan 2023, 12:09 AM
ঘোষণা দিয়ে ফিরে আসা লোড শেডিং ডিসেম্বরে শীত শুরুর পর কিছুটা থেমেছিল; এক মাসের মাথায় আবারও ঢাকাসহ দেশজুড়ে পালা করে চলছে বিদ্যুতের যাওয়া-আসা।
পৌষের শেষে শুরু হওয়া উত্তরী হাওয়া আর ঘনকুয়াশায় কনকনে শীতের দিনগুলোতে চাহিদা কম থাকার মধ্যেই গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের লোড শেডিং হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে বলে জানাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা।
এর কারণ হিসেবে কয়লা ও গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারও হোঁচট খাওয়ায় ঘাটতির মুখে লোড শেডিং করছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিতরণকারী সংস্থাগুলো। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যদিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ একদম কমে গেছে, সে কারণে এই পরিস্থিতি। পাশাপাশি ভারতেও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ত্রুটি দেখা দেওয়ার কারণে সেখান থেকে ১৫০ মেগাওয়াটের মত কম আসছে।
“আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি।”
সূচি ‘এলোমেলো’: ২৪ ঘণ্টায় লোড শেডিং 'চার-পাঁচবার'
মার্চে আসছে আদানির বিদ্যুৎ: প্রতিমন্ত্রী নসরুল
তবে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন) মো. কামরুজ্জামান খানের দাবি, গ্যাসের সরবরাহ গত আড়াই মাস ধরে একই ধারাবাহিকতায় রয়েছে। পিডিবির পক্ষ থেকে আরও ৫০ থেকে ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস বেশি চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শিল্পের গ্যাস চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সেটা এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিতে হলে শিল্প সংযোগের গ্যাস কমিয়ে দিতে হবে।
“গ্যাসের জোগানের তুলনায় চাহিদা সবসময় বেশি। কিন্তু সেটা নতুন কিছু নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গড়ে ৮৫০ এমএমসিএফডি করে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।”
পেট্রোবাংলার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত নভেম্বর- ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যে পরিমাণ গ্যাস দেওয়া হত জানুয়ারিতে তা একই রয়েছে।
কয়লা ও তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে গিয়ে লোড শেডিংয়ের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
মঙ্গলবার পিডিবির উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সোমবার (১৬ জানুয়ারি) বিকালের দিকে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৯৭০ মেগাওয়াট; এসময় সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৯ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। ওইদিন দেশের নয়টি বিতরণ অঞ্চল মিলিয়ে মোট লোডশেডিং ছিল ৯৫২ মেগাওয়াট।
একইভাবে ১৫ জানুয়ারি ৪৯৬ মেগাওয়াট, ১৪ জানুয়ারি ২৩৪ মেগাওয়াট, ১২ জানুয়ারি ৩৯৯ মেগাওয়াট, ১০ জানুয়ারি ১৭৯ মেগাওয়াট, ৯ জানুয়ারি ৯৫২ মেগাওয়াট ও ৮ জানুয়ারি ৪৮০ মেগাওয়াট লোড শেডিং ছিল।
এমন অবস্থার মধ্যে গত কয়েকদিন থেকে রামপাল কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদনে আসা ইউনিটে কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পিডিবির তথ্যে দেখা যায়, এ কেন্দ্রে ৫০০ থেকে ৬২৪ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে আসছিল। পদ্মা নদীতে স্থাপিত বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন চালুর হওয়ার পর এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় তা লোড শেডিং কমাতে ভূমিকা রেখেছিল।
রামপালসহ চালু থাকা ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৬০২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে পাঁচটিতেই কয়লা সংকটের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বড়পুকুরিয়ায় ২৭৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি ইউনিটে ২৪ মেগাওয়াট থেকে ২৫০ মেগাওয়াটের মধ্যে উৎপাদন ওঠানামা করছে। বাকি দুইটি ইউনিটের প্রতিটিতে ৮৫ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। সব ইউনিটেই কয়লার সংকট রয়েছে।
রামপাল, ভারতের বিদ্যুতে কাটবে লোড শেডিং: জ্বালানি উপদেষ্টা
চাহিদা-উৎপাদনের ফারাকে লোড শেডিং আরও বাড়ছে
বরিশালে ৩০৭ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা স্বল্পতার কারণে বসে আছে। আর রামপালে বর্তমানে ৬১৭ মেগাওয়াট উৎপাদনের প্রস্তুতি থাকলেও কয়লা সংকটের কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে ছোটবড় ৬৮টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে গ্যাসের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে বলে পিডিবির দৈনন্দিন উৎপাদনের তথ্য জানাচ্ছে। এছাড়া কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম চলছে।
অপরদিকে বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে দৈনিক ১০০০ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সূর্যমনি থেকে কুমিল্লা হয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। এক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রে ক্রুটির কারণে কম আসছে ১৫০ মেগাওয়াট।
উৎপাদন ও আমদানি বিদ্যুতের যোগানের এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকোর কর্মকর্তারা জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন তারা। তবে এরমধ্যে কয়েকদিন চাহিদার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ মিলেছে।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের বিতরণ এলাকায় মঙ্গলবারও ১০০ মেগাওয়াটের মত লোড শেড করতে হয়েছে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে উৎপাদন পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে বলে তাদের জানানো হয়েছে।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাউসার আমির আলী জানান, তার এলাকায় গত সোমবার ৫০ মেগাওয়াট লোড শেডিং হয়েছে। মঙ্গলবার তেমন হয়নি। গত এক সপ্তাহের পরিস্থিতি এরকমই বলে জানান তিনি।
পরিস্থিতি নিয়ে যা বলছেন এক বিশেষজ্ঞ
গত জুলাই-অগাস্টে সরকার বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি কেনা কমিয়ে দেওয়ার পর গ্যাস সংকটের কারণে ঘোষণা দিয়ে লোড শেডিং ফেরানো হয়েছিল। তখন দৈনিক প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সাড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছিল। মাঝখানে দেড় হাজার মেগাওয়াট চাহিদার কিছু অংশ পূরণ করা হয়েছিল ফ্যান-এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, অফিস আদালতের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনাসহ ভাচুর্য়াল বৈঠক করার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে। পাশাপাশি নিয়ম করে একেক দিন একেকটি শিল্প এলাকায় সপ্তাহিক ছুটি ঘোষণার কৌশলও নেওয়া হয়েছিল।
এরপর শীতে চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে নেমে আসার পর নতুন করে লোড শেডিংকে বিদ্যুতের নাজুক পরিস্থিতি হিসেবে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।
তার ভাষ্য, “একটা ভয়ংকর রকমের জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। এগুলো হচ্ছে সামগ্রিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের ফল। তেল নেই, কয়লা নেই, গ্যাস নেই, কেনার পয়সাও নেই। এসব কারণে তারা উৎপাদন করতে পারছে না। তাহলে লোড শেডিং তো হবেই। এখন শীতকাল না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হত।”
ডলার সংকটে কয়লার আমদানি নেই, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ
বাণিজ্যিক উৎপাদনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে ৬৬০ মেগাওয়াট
আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশ্বাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তাদের আশ্বাসের কোনো বাস্তবতা নেই। তারা বলেছিল সেপ্টেম্বর এলে লোডশেডিং কমে যাবে। কই সেপ্টেম্বর গিয়ে অক্টোবর গেল, তারা পারল? এখানে অস্বাভাবিক বা আকস্মিক কিছু নেই। এখন যা হচ্ছে এটাই বাস্তবতা। আমরা আগেই বলেছিলাম, তারা তেল কেনার পয়সা পাবে না।”
নিয়মকানুন না মানার অভিযোগ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, “তাদের আচরণ বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। সুতরাং এই পরিস্থিতি হবে এটা আগেই অনুমেয় ছিল, আমরা বলেছিও। বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের নামে যা কিছু করা হয়েছে, এগুলো কোনো নিয়ম কানুনের মধ্যে পড়ে না।”