“তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) একটা সময় দিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে পরিষ্কার রোডম্যাপ কী হতে পারে?,” বিফ্রিংয়ে বলেন তিনি।
Published : 17 Dec 2024, 08:10 PM
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের আগামী নির্বাচন নিয়ে ধারণা দেওয়ার পরদিন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে কম সংস্কার হলে তা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে এমন এক প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, “নির্বাচনি রোডম্যাপ খুব স্পষ্ট দেওয়া হয়েছে। যদি কম সংস্কার হয় তাহলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) একটা আলোকপাত করেছেন। চূড়ান্ত তারিখ কী? সেটা নির্ভর করবে সংস্কারের উপর। তিনি একটা সময় দিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে পরিষ্কার রোডম্যাপ কী হতে পারে?
”আপনি আশা করতে পারেন নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে।’’
আগের দিন সোমবার বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ভোট কবে হবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কতটা সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া হবে, তার ওপর। মোটাদাগে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর অন্তর্বতী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার চার মাসের মধ্যে পরর্বতী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে।
এসময়ে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, এমনকি সেনাপ্রধানও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন, তবে সেগুলো ছিল তাদের ব্যক্তিগত অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
এরমধ্যে বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তোলা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন’ যাত্রা শুরু করেছে, সেই ট্রেন আর ‘থামবে না’।
তবে সেদিন এর আগে রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি।
এর এক মাসের মাথায় বিজয় দিবসের সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে প্রথমবারের মত নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে কথা বললেন ইউনূস।
পরদিন মঙ্গলবার নিয়মিত বিফ্রিংয়ে নির্বাচন বিষয়ক প্রশ্নে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘এটা তো স্পষ্ট রোড ম্যাপ।এখন আপনি যদি বলেন মনোনয়ন দাখিলের সময় কবে?”
এসময় এ বিষয়ে উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, “নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, কবে মনোনয়ন দাখিল হবে এগুলো নির্বাচন কমিশনের কাজ। সরকারের কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়।
”এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের জাতীয় দাবি আছে রাজনৈতিক দল ও মানুষের পক্ষ থেকে। জুলাই বিপ্লবের চেতনাও হচ্ছে এটা। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভোট দিতে পারে নাই। প্রধান উপদেষ্টার কাছে তরুণদের দাবি তারা যেন ভোট দিতে পারে, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত যেন হয়।''
সংস্কার কমিশনগুলো দ্রুত প্রতিবেদন দেবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় উদ্যোগের চেষ্টা হবে সেই লক্ষ্যে একটি জাতীয় ঐক্যমত কমিশন গঠন করারও প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দিয়েছেন।
”জাতীয় ঐক্যমতে সংস্কারের বিষয়গুলো তৈরি হয়ে গেলে নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিতে পারবে।''
নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ কমিশন শুরু করে দিয়েছে বলে তুলে ধরে উপ প্রেস সচিব বলেন, '' নির্বাচনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানতে হলে সবার উচিত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মোটাদাগে সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা বলেছেন।
”এসময়ে মধ্যে থেকে নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে যে যে প্রয়োজনীয়তার কথা ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে বা এখনো আলোচনা হচ্ছে বা সামনে যে ইস্যুগুলো আসবে সেগুলো নিয়ে সরকার কীভাবে কাজ করবে তার রূপরেখা, পদ্ধতির আউটলাইন প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ঘোষণা করেছেন।''
বিজয় দিবসের দিন প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়েও গুরুত্ব দেন।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের কথা তুলে ধরে তিনি তিনি বলেন, “আমি সকল প্রধান সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ত সম্ভব হবে।
“আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম পর্যায়ে যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সেগুলোর চেয়ারম্যানদের নিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার কথাও বলেন।
তিনি বলেন, “এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।”
মঙ্গলবারের প্রেস বিফ্রিংয়ে নির্বাচন বিষয়ক প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে প্রেস সচিবদের কাছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলাদা আলাদা বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে সরকার কাকে গুরুত্ব দেবে এমন প্রশ্নে উপ প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, “সরকার সবাইকে গুরুত্ব দেবে। এখানে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতি যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে পৌঁছাতে পারে। সেজন্য যেসব স্টেকহোল্ডার রয়েছে তাদের সবার মতামত নিয়ে একটা সম্মিলিতভাবে পৌঁছে জাতির জন্য কল্যাণ হয় সেরকম সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।''
জাতীয় ঐকমত্য হলে নির্বাচনের সময়সীমা বাড়বে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,'' যখন পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন দেখা যাবে। এ বিষয়ে এখন ধারণা জল্পনা-কল্পনার সময় হয়নি।''
আওয়ামী লীগের বিচারের পরে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ''জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের আলোচনায় যদি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব আসে কিংবা আদালত থেকে কোন নির্দেশনা আসে। সবগুলো বিষয় বিবেচনা করে সরকার যদি মনে করে তাহলে সিদ্ধান্ত নেবে। ''
এসময় প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ''জুলাই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ডে যারাই জড়িত, যাদের হাতে রক্ত আছে। তাদের বিচার হবেই। এখানে কোনো মাফ নেই। যারা গুমে জড়িত ছিলেন তারা রাজনৈতিক দল হোক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হলেও বিচার হবেই। এইটুক নিশ্চিত থাকতে পারেন।''
আওয়ামী লীগের নেতা ও অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেশত্যাগের অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ''বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। অনেকগুলো বিষয় জানতেও পেরেছি। ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশে ছিলেন কি ছিলেন না, সেই প্রমাণ সরকারের হাতে নেই।''
বিজয় দিবসে রাষ্ট্রপতি একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও এড়িয়ে গেছে।
’টেকনিক্যালি রাষ্ট্রপতিকে’ এড়িয়ে যাওয়া না কি অন্য কোনো কারণে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কেউ যায়নি, এমন প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, ''এটি বিজয় দিবসের প্রোগ্রাম ছিল, ওইখানে এড়ানোর কিছু নেই। পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট এসেছেন বাংলাদেশে। এখানে উনি একটা অনুষ্ঠান করেছেন, ইনভাইট করেছেন, অনেকে গিয়েছে, অনেকে যায়নি।''
বাজেট সংশোধনের আগে ‘মূল্যায়ন’
বাজেটে কোনো সংশোধনী আসবে কি না এরকম এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আগের চোর জননী যে অবস্থায় অর্থনীতিকে রেখে গিয়েছিলেন, ৯০০ মিলিয়ন ডলার রেখে গেছেন আদানি পাওয়ারের বিল, গ্যাস কোম্পানি শেভরন থেকে সবাই আপনার কাছে টাকা পাচ্ছে। বিদেশ থেকে এলএনজি আনছেন তারা বিলিয়নস অব ডলার পাওনা। প্রথমে আমাদের কাজ ছিল আন্তর্জাতিকভাবে একটি রাইট সিগন্যাল দেওয়া যে আমরা আপনাদের টাকাগুলো খুব দ্রুত পরিশোধ করছি। সে অনুযায়ী শেভরনের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে তাদের পাওনা পরিশোধ করব, আদানিকে এইভাবে টাকাগুলো দিচ্ছি তারা হ্যাপি। এই পুরো সমস্যাগুলোতো ওইখান থেকে তৈরি।
”ওইটাকে ফাস্ট অ্যাড্রেস করতে হচ্ছে। এরপর সামনের দিকে চিন্তা করতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, ”বাজেট এমনভাবে রিভিউ করা যাতে প্রায়োরিটি এরিয়া, যেখানে টাকা খরচ করতেই হবে সেই জায়গায় যাতে খরচ করতে পারি। অপ্রয়োজনীয় জায়গা থেকে সরিয়ে যাতে অন্য কাজের জায়গায় খরচ করতে পারি, সেটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।”
‘বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ হবে
প্রেস সচিবব বলেন, ’’বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ছিল। এখানে মঞ্জুরি শব্দটা বাদ দিয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ হবে। কারণ বাংলাদেশে অনেকগুলো পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যাতে আরও বৃহৎ আকারের কাজ করতে পারে। সর্বোচ্চ শিক্ষার মান যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় সেই কাজ বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন করবে।’’
আরও পড়ুন
এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন, ধারণা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টাকে 'সাধুবাদ' দিলেন মির্জা আব্বাস, চাইলেন
আন্তরিক হলে আগামী ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব: খন্দকার মোশাররফ