তিনটি ভূগর্ভস্থ জলাধারে পর্যাপ্ত পানি না থাকার বিষয়টিও প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
Published : 31 Dec 2024, 11:22 PM
আগুন ‘শনাক্তের ব্যবস্থা না থাকায় বৈদ্যুতিক গোলাযোগ’ থেকে আগুন লেগে তা দ্রুত ছড়াতে পেরেছে, এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে প্রাথমিক তদন্তে।
তদন্ত কমিটি বলেছে, ভবনের করিডোরের ফলস সিলিং দাহ্য ও অতি দাহ্য পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় অতি দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
সচিবালয়ের ভেতরে তিনটি ভূগর্ভস্থ জলাধারে পর্যাপ্ত পানি না থাকার বিষয়টিও প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়।
পরে সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি সংবাদিকদের সামনে আসেন।
তিনি বলেন, “বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ছিল, দমকল বাহিনীর যারা ফায়ার হ্যান্ডেল করে তাদের এক্সপার্ট ছিল, সেনাবাহিনী থেকে তাদের বোম্ব স্কোয়াড ছিল, তাদের বিশেষায়িত ককুরগুলো-ডগ স্কোয়াড তারাও কাজ করেছে। পুলিশের সিআইডি থেকে তারা কাজ করেছে।
“এরা সকলে মিলে একত্রে একটি বিষয়ে এক মত হয়েছি যে এটি একটি লুজ কানেকশনের কারণে ইলেকট্রিসিটি থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছে। এটি আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত। এতে অন্য কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা আমরা খুঁজে পাইনি।”
গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
ভয়াবহ এ আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে পানির সরবরাহ লাইন সংযোগ দেওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী ট্রাক চাপায় নিহত হন।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা সময় ধরে জ্বলা এ আগুন লাগার পর তা দুর্ঘটনা না কি নাশকতা সেই আলোচনাও সামনে আসে। সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকেও ষড়যন্ত্র ও নাশকতার বিষয়টি সামনে আনা হয়। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুনের সূত্রপাত ‘বৈদ্যুতিক গোলযোগ’ হিসেবে উঠে এল।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার।
কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়, যে সময়সীমা শেষ হয় সোমবার। পরে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় একদিন বাড়িয়ে নেয় কমিটি।
কমিটি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে যে ‘বৈদ্যুতিক স্পার্ক’ থেকেই আগুন লেগেছে। তবে আরো অধিকতর নিশ্চিত হতে দগ্ধ বৈদ্যুতিক ক্যাবল সেগমেন্ট, জয়েন্ট বক্স এবং ব্রেকারগুলির নমুনা পরীক্ষা করার কথা বলেছে।
তদন্ত কাজে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রাথমিক অবস্থান প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেছে।
বুয়েট দলের পর্যবেক্ষণ
ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট বলছে, ‘বৈদ্যুতিক স্পার্ক’ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুনের উৎপত্তিস্থল সাত নম্বর ভবনের ষষ্ঠতলার লিফট লবি সংলগ্ন করিডোর থেকে। ১টা ৩০ থেকে ১টা ৪০ মিনিটের মধ্যে সূত্রপাত হয়ে রাত ২টার দিকে আগুন ‘ডেভলপ স্টেজ-এ (বিকশিত স্তর)’ চলে যায়।
“এটি একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, এ ধরনের অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত পানির প্রবাহে ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষের অধিকাংশ আলামত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম না থাকায় সূচনা এবং বিকশিত অবস্থায় আগুন শনাক্ত করা যায়নি।”
ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে বুয়েট তাদের অনুসন্ধানে বলছে, টানেল সদৃশ্য করিডোরের ফলস সিলিং দাহ্য ও অতি দাহ্য পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় আগুন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
“ভবনের লিফট ও সিঁড়ির অপরিকল্পিত নকশার কারণে চিমনি এফেক্ট সৃষ্টি হয়, যাতে অগ্নিশিখা দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী প্রপাগেশন করে ষষ্ঠতলা থেকে ৭, ৮ ও ৯ তলায় ছড়িয়ে যায়।”
করিডোরে আগুনের কারণে রুমগুলোর দরজা পুড়ে যায়। রুমের ভেতরে দাহ্যবস্তু (কাগজ, কাপড়, ফোম, কার্পেট, ফার্নিচার) থাকায় পরে সেখানেও আগুন ধরে যায়। বিভিন্ন রুমে দাহ্য পদার্থের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় সেগুলোর ক্ষতিও একেক রকম।
“ষষ্ঠতলার ৫২৪ নম্বর এবং অষ্টমতলার ৭০৪ নম্বর কক্ষ দুটির এয়ারকন্ডিশন থেকে রেফ্রিজারেন্ট নির্গত হয়ে প্রজ্বলনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে প্রতীয়মান হয়।”
সেনাবাহিনীর বোম্ব স্কোয়াড যা পেয়েছে
বিস্ফোরক ব্যবহার করে নাশকতা ঘটানো হয়েছে কি না তা যাচাই করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের তিনটি সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। নমুনাগুলো তাদের কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয় বিস্ফোরক শনাক্ত করার তিনটি আধুনিক যন্ত্র।
“চারটি নমুনা পরীক্ষা করে কোন বিস্ফোরকের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়নি। সংগ্রহকৃত একটি নমুনা বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করে কোনো রকম ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া যায়নি।”
এছাড়া সেনাবাহিনীর ডগ স্কোয়াডের কোনো ধরনের বিস্ফোরকের উপস্থিতি না পাওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
ফায়ার সার্ভিস যা বলছে
প্রাথমিক প্রতিবেদনে সচিবালয়ে আগুন নেভোনোর কাজ ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভারে কথা বলেছে ফায়ার সার্ভিস। তাছাড়া উঁচু মই সংযুক্ত গাড়ি প্রবেশেও বাধা কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি তলায় করিডোরে চারটি কলাপসিবল গেইট তালা দিয়ে আটকানো ছিল এবং সেখানে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও তাপ সৃষ্টির ফলে তালা কেটে ভিতরে ঢুকতে সময় লেগেছে।
প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়েছে, “প্রতিটি ফ্লোরে ইন্টেরিওর ডিজাইন অতীব মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়, যা উচ্চ মাত্রার দাহ্যবস্তু এবং আগুন বিস্তারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রতি তলায় অধিকাংশ রুমে উচ্চ ও সহজ দাহ্যবস্তু দ্বারা কক্ষগুলো বিভাজন করা ছিল।
“প্রত্যেকটা ফলস সিলিং-এর উপরে বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক তারসহ অন্যান্য তার বিদ্যমান ছিল। কোনো কোনো রুমের পরিমাপ অনুপাতে অপেক্ষাকৃত বেশি ইন্টেরিওর ডেকোরেশন, কাগজপত্র ও আসবাবপত্র বিদ্যমান ছিল।”
আগুন লাগা সাত নম্বর ভবনে বিপদ সংকেত দেওয়ার ও আগুন শনাক্ত করার ব্যবস্থা, কন্ট্রোল প্যানেল, পানি ছিটানোর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাসহ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনে কোনো কোনো তলায় হোসপাইপের ব্যবস্থা থাকলেও তা ছিল অকার্যকর। পাইপগুলোতে নজেল ছিল না।
এসব কারণে হাত দিয়ে লাইন খুলে প্রতিটি তলায় ফায়ার সর্ভিসের হোসপাইপ দিয়ে পানি দিতে হয়েছে, যা ছিল সময়সাপেক্ষ।
সচিবালয়ের ভূগর্ভস্থ জলাধার তিনটিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে প্রাথমিক প্রতিবেদনে ফায়ার সার্ভিস বলেছে, “দূরবর্তী স্থান- ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন ও গেইটের বাইরে বিশেষ পানিবাহী গাড়ি হতে অনেক হোসপাইপ লে-আউট-এর মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছে। এছাড়া ওয়াসা কর্তৃক পানি সরবরাহ করা হয়েছে।”
তদন্ত কমিটির পরবর্তী কার্যক্রম
>> আগুনের উৎপত্তিস্থল থেকে ৩০ ডিসেম্বর যে সকল নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হবে।
>> পুলিশ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত সাত নম্বর ভবন এবং আশপাশের ভবনের সকল সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করছে।
>> আগুনটি বৈদ্যুতিক উৎস থেকে শুরু হয়েছিল কিনা তা আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য বুয়েট পুড়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক ক্যাবল সেগমেন্ট, জয়েন্ট বক্স ও ব্রেকারগুলির নমুনা পরীক্ষা করবে।
>> প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া বৈদ্যুতিক গোলযোগের বিষয়টির সঙ্গে অন্যকোনো ব্যক্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।
আরো পড়ুন: