গুলি করার জন্য মামলায় দায়ী করা হয়েছে রায়েরবাজার ফাঁড়ির এসআইকে। শেখ হাসিনা, দুই মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশকে বলা হয়েছে নির্দেশদাতা।
Published : 26 Aug 2024, 09:56 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে এক কলেজ ছাত্র নিহতের ঘটনায় তার বাবা থানায় মামলা করে তিনটি ভিডিও ফুটেজ জমা দিয়েছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ‘হত্যার’ জন্য একজন এসআইকে দায়ী করে নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার দুইজন সদস্য, স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্যের পাশাপাশি ৯ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে গত ১৯ জুলাই বিকালে কলেজ ছাত্র মাহামুদুর রহমান সৈকতকে হত্যার অভিযোগে রোববার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি করেন তার বাবা মাহাবুবের রহমান।
মামলায় সদ্য এসএসসি পাস করা সৈকতকে গুলি করার জন্য দায়ী করা হয়েছে রায়েরবাজার ফাঁড়ির এসআই শাহরিয়ার আলমকে। শেখ হাসিনাসহ বাকিদের ‘নির্দেশদাতা’ বলা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, মোহাম্মদপুরের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক, মোহাম্মদপুর জোনের সাবেক এডিসি রওশানুল হক সৈকত, মোহাম্মদপুরের সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) শহীদুল হক, মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান, মোহাম্মদপুর থানার সাবেক ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া, পরিদর্শক (তদন্ত) তোফাজ্জল হোসেন।
মামলার সঙ্গে ঘটনাস্থলের তিনটি ভিডিও থানায় জমা দিয়েছেন মাহাবুবের।
মামলার ভাষ্য, ১৯ জুলাই আনুমানিক বেলা ৩টায় সৈকত তার মাকে জানায়, তার এক বন্ধু পুলিশের ছোঁড়া ছররা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছে। তাকে সাহায্য করার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে সে নূরজাহান রোড এলাকায় এসে গুলিবিদ্ধ বন্ধুকে খুঁজতে থাকে।
এ সময় আন্দোলনকারীদের একটি মিছিল নূরজাহান রোড দিয়ে যাচ্ছিল। সৈকত সে মিছিলের সামনের সারিতে পড়ে যায়। মিছিল চলে গেলেও সৈকত সেখানেই রয়ে যায়।
সেখানে আরও কিছু ছাত্র-জনতা অবস্থান করছিল। এ সময় সেখানে মোহাম্মদপুর থানার তৎকালীন ওসি ও পরিদর্শককে (১১ ও ১২ নম্বর আসামি) সৈকতের অবস্থান করার বিষয়টি জানান এসআই শাহরিয়ার আলম।
মামলায় বলা হয়, ১ নম্বর (শেখ হাসিনা) থেকে ১২ নম্বর আসামির নির্দেশনা মোতাবেক সৈকতকে গুলি করেন শাহরিয়ার।
মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসআই শাহরিয়ার বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটে সৈকতকে লক্ষ্য করে গুলি করলে সেটি মাথার বাম পাশ দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়; এরপর সবাই ধরাধরি করে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন, মামলায় অভিযোগ করেন মাহাবুবের।
শাহরিয়ার আলমের গুলি করার তথ্য ‘কিছু লোকের’ ফেইসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারার কথাও লেখেন বাদী।
সৈকতের এক বন্ধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের সামি গত ২৬ জুলাই নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে একটি পোস্টে সৈকতকে গুলি করার বিষয়টি প্রকাশ করেন। তার পোস্টে সৈকত ও এসআই শাহরিয়ার আলমের ছবি ব্যবহার করা হয়। সেই বিষয়টি অনেকে শেয়ার করলে তাদেরও নজরে আসে।
ওই পোস্টে জুলকারনাইন শায়ের মাঠ পর্যায়ের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন, “…১৯ জুলাই দুপুরে সৈকত মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের প্রাইমারি স্কুলের গলিতে ঘোরাঘুরি করছিল, এ মাথা থেকে ওমাথা দৌড়াচ্ছিল। ছাত্র আন্দোলনের কোন মিছিল আসলে সে তাতে যুক্ত হচ্ছিল এবং মিছিলের সামনের ভাগে অবস্থান করছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
“সৈকতের এই তৎপরতা বেশ চোখে লাগে সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের সহকারী পরিদর্শক শাহরিয়ারের। সৈকতের বিষয়ে শাহরিয়ার আরেক পুলিশ সদস্যকে বলেন ‘ছেলেটা খুব ডিস্টার্ব করতেছে’। একটু পরেই বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে এসআই শাহরিয়ার তার সহকর্মীর কাছ থেকে চাইনিজ টাইপ ৫৬ এসকেএস রাইফেল নিয়ে ১৫-২০ ফুট দূরে থাকা সৈকতকে লক্ষ্য করে সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটি গুলি করেন। প্রশিক্ষিত শ্যুটার এসআই শাহরিয়ারের ছোঁড়া বুলেট সৈকতের গলায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়।”
এ ঘটনা যাচাইয়ের জন্য এসআই শাহরিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে মামলার আসামি মোহাম্মদপুর থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে সেই সংঘাতের সময় আমরা কয়েকজন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড বটতলা এলাকায় অবস্থান করছিলাম। বিক্ষুব্ধ ছাত্রে-জনতা তখন তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থান করছিল। আমরা নূরজাহান রোডে ছিলাম না কিন্তু তবুও আসামি করা হয়েছে।”
বোনদের ভালোবাসার ‘টুনা’
নিহত সৈকতের বাবা মাহাবুবের রহমানের নূরজাহান রোড এলাকায় একটি খাবারের দোকান রয়েছে। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সৈকত সবচেয়ে ছোট। বড় দুই বোন আদরের ছোট ভাইটিকে ‘টুনা’ নামেই ডাকত।
সৈকত নিহত হওয়ার পর গত ২৫ জুলাই তার বড় বোন সাব্রিনা সেবন্তি নিজের ফেইসবুকে ভাইকে নিয়ে আবেগময় একটি পোস্ট দেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে। মন্তব্য করে প্রচুর মানুষ তাদের সমবেদনা জানান।
সেই পোস্টে সাব্রিনা সেবন্তি নামে একজন লিখেন, “ছবির ছেলেটা আমার ভাই, আমাদের দুই বোনের একমাত্র আদরের ভাই। আমরা ওকে কী পরিমাণ ভালোবাসি এটা হয়ত কখনও আর তাকে বলাই হবে না, সুযোগ কই?
“যেদিন প্রথম আম্মু তাকে বাসায় আনে, এসেই সে আমাদের দুই বোনের গায়ে সসম্মানে হিসু করে ভালোবাসার জানান দেয়। আমাদের ছোট্ট বাবুটাকে আমরা টুনা ডাকতাম, ভালোবাসার ডাক আরকি। ছোট্ট টুনা বড় হয়ে বড় টুনা হইল, কিন্তু টুনাই রয়ে গেল আমাদের কাছে, সৈকত হইতে পারল না। কি রাগ তার! ‘আমাকে বন্ধুদের সামনে টুনা ডাকবানা তো সেবন্তি আপু’।”
আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ২০ বছর হওয়ার কথা ছিল সৈকতের। সে কথা উল্লেখ করে তার বোন লেখেন, “জন্মদিনের কয়েকদিন আগে থেকেই গান গাওয়া শুরু করত, ‘সেবন্তি আপু, কী কেক বানাবা তুমি?’ কত হাসিখুশি ছিলাম আমরা। এখন বুকে খালি হাহাকার, কী যেন নাই, নাই তো নাইইইইইইইই!”
“আমার ফুলের মত ভাইটাকে ঠান্ডা মাথায় টার্গেট করে মাথায় গুলি করা হয়েছে। বাবার কাঁধে ছেলের লাশের চেয়ে ভারী এই পৃথিবীতে কিছু আছে?”