ডেঙ্গুতে শিশুকে নিয়ে বেশি ভয়ে অভিভাবকরা, মৃত্যুও বেশি

মশাবাহিত এ রোগে এ বছর এখন পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিশু; তীব্র জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

ওবায়দুর মাসুমজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2022, 07:02 PM
Updated : 7 Nov 2022, 07:02 PM

পিঠাপিঠি দুই ভাই বোনের জ্বর আসে একই দিন। পরীক্ষায় দুজনেরই ধরা পড়ে ডেঙ্গু। এরপর ভাইটির রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকের পরামর্শে নেওয়া হয় আইসিইউতে, পরদিন ভোররাতে মারা যায় সে।

ঢাকার একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র নয় বছরের মোহাম্মদ সিয়ামকে হারানোর বিষয়টি এখনও মেনে নিতে পারছে না সায়েদাবাদে বসবাসকারী পরিবারটি।

সিয়ামের বাবা আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত ২৯ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যায় সিয়াম। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের পাশাপাশি তার নিউমোনিয়াও ধরা পড়ে।

“গত ২৩ অক্টোবর থেকে আমার, ছেলে সিয়াম ও আট বছর বয়সী মেয়ের জ্বর আসে। পরদিন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলে সবার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সিয়ামের প্লাটিলেট ২৩ হাজারে নেমে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, জ্বর আসার সময়কার কথা বলছিলেন ছেলে হারানো এ পিতা।

তিনি বলেন, “প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করাই। ২৮ অক্টোবর ডাক্তার বলে তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। সেদিনই নিউ লাইফ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। ২৯ তারিখ ভোররাতে সে মারা যায়।“

এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে সিয়ামের মত অনেক শিশুর মৃত্যুর খবর আসছে। ছোট্ট শিশুদের হারিয়ে পরিবারে শোকের মাতম বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বছরের শেষ দিকে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রাণঘাতি রূপে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ শিশু। ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গেছে তার ২৫ শতাংশই শিশু।

বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, অসময়ে ডেঙ্গু যে শুধু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তা নয়, উপসর্গ ও ধরনে এসেছে পরিবর্তন। এ কারণে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশেষ করে শিশুদের জ্বর হলে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলছেন তারা।

এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা যেসব লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে আসছে, সেগুলো এর আগে তেমন দেখা যায়নি। কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, হঠাৎ অবস্থার অবনতিতে অনেকেই মারা যাচ্ছে, বলছেন চিকিৎসকরা।

এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের তীব্র জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু আক্রান্ত বড় বাচ্চাদের বেশি জটিলতা দেখা দিচ্ছে যা আগে ছিল না।

“বড় বাচ্চাদের মধ্যে অনেকে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের লক্ষণ উপসর্গ এবার একটু আলাদা।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত রোববার পর্যন্ত এবছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ। এসময়ে এইডিস মশাবাহিত এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের। গত বৃস্পতিবার পর্যন্ত ৪০ হাজার ১০১ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৭ হাজার ৮৬৯ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ হিসাবে মোট আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর হার ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। ওই দিন পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৫২ জনের মধ্যে ৩৮ জন শিশু। এ হিসাবে মৃতদের মধ্যে শিশু শতকরা ২৫ শতাংশ।

শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ এবারের চিত্র একটু ভিন্ন বলে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

তার মতে, আগে ডেঙ্গুতে যে ধরনের লক্ষণ ছিল তা কিছুটা পাল্টে গেছে। এবার ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, বমি, কারও কারও কার্ডিয়াক কমপ্লিকেশন, নিউরোলজিক্যাল কমপ্লিকেশনও হচ্ছে।

“এটা কেন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন আছে।”

বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে হাসপাতালে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এর বেশি বয়সীদের ভর্তি করা হয় কিশোর-কিশোরী ওয়ার্ড বা মেডিসিন বিভাগে। 

  • আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ১ হাজার ৪২৭ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম।

  • ২ হাজার ৬২৪ জনের বয়স ৫ থেকে ১০ বছর।

  • ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ২ হাজার ২৫৮ জন

  • ১ হাজার ৫৬০ জনের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।

  • ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৩৮ শিশুর মধ্যে ৮ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম।

  • ৫ থেকে ১০ বছরের ১৪ জন।

  • ১০ থেকে ১৫ বছরের ৯ জন।

  • ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৭ জন।

হাসপাতালে ভিড়

রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ভিড়। নতুন রোগীও আসছে প্রতিদিন।

গত শনিবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২৬ জন ভর্তি ছিল। এদিন ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট রোগী ছিল ১০৪ জন।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা ১২ বছর বয়সী স্কুলছাত্র নাবিল হাসান আট দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। অবস্থা খারাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে গত মঙ্গলবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ডেঙ্গু: দ্রুত কমছে প্লাটিলেট, লাগছে রক্ত

ডেঙ্গুতে মৃত্যু আগের হিসাব ছাড়িয়ে গেল

ডেঙ্গুতে এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু অক্টোবরেই

নাবিলের মা সাথী বেগম জানান, জ্বর না কমলে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর বাসায় থেকে চিকিৎসা চললেও অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে যায়, নড়তে-চড়তে পারে না।

তখন চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে এনে ভর্তি করার কথা জানান তিনি।

রাজশাহী থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকার বাড্ডায় মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিল আবদুর রাফি নামে ৬ বছর বয়সী এক শিশু। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সেও ভর্তি হয়েছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।

রাফির মা জাকিয়া সুলতানা জানান, ঢাকায় আসার পাঁচ দিনের মাথায় জ্বর আসে। ছেলের প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, খুব বমি হচ্ছিল। পেটে কিছুই থাকছিল না।

“অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, হাসপাতালে আনার পর ভর্তি করে নিয়েছে,” বলেন তিনি।

এ হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফেরদৌসী হাসনাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা নানাধরনের লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছে, আগে তেমন ছিল না।

“পেট ফুলে যাওয়া, পেট ব্যথা, বুকে ব্যথা, তীব্র বমি, কারও কালো পায়খানা, কারও নাক দিয়ে রক্ত পড়ার মতো উপসর্গ নিয়ে আসছে। আরেকটা বিষয় হলো এবার আমরা অনেক ছোট বাচ্চাও পাচ্ছি। পাঁচ-ছয় মাসের শিশু তো আছেই, আমাদের এখানে সাতদিন বয়সী শিশুও পেয়েছি যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।”

শনিবার থেকে রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি ১৯৪ জন রোগীর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছিল ৩৬ জন। শুক্রবার ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে আড়াই বছর বয়সী ইয়াকিন হোসেন।

তার মা মায়মুনা বলেন, “এমন জ্বর আসছে। সাথে জ্বর, বমি, পেটব্যথা, বুক ব্যথা আর পাতলা পায়খানা। বাচ্চা খুবই দুর্বল হইয়া গেছে।”

শনিবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি ছিল ৭৩ শিশু।

কামরাঙ্গীরচর থেকে দেড় বছর বয়সী ইয়াসিনকে নিয়ে এ হাসপাতালে আসা তার মা সুমাইয়া বেগম বলেন, “তার জ্বর প্রায় তিন সপ্তাহ ধইরা। ডাক্তার দেখাইয়া ওষুধ খাওয়াইছি, কিন্তু জ্বর সারে না। পরে রক্ত পরীক্ষা কইরা ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। খুব বমি করতাছে।”

এ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাসার বাইরে স্কুল, বিনোদনকেন্দ্রে যাচ্ছে শিশুরা। এ কারণে মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে, আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে।

সর্দিকাশির সঙ্গে জ্বর হলে ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রথম তিন দিন জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকবে। জ্বর কমে গেলেই সমস্যাগুলো বেশি দেখা দেয়। সে সময় যেন তারা চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকে। আর প্রচুর পানি এবং তরল খাওয়াতে হবে শিশুদের।