র‌্যাবও বলল, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন

এই বুয়েটছাত্রের মৃত্যুর তদন্ত নিয়ে একই উপসংহারে পৌঁছল র‌্যাব ও ডিবি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2022, 02:53 PM
Updated : 14 Dec 2022, 02:53 PM

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশ দাবি করার পর তার সমর্থন মিলল র‌্যাবের কাছ থেকেও।

এই তরুণের লাশ উদ্ধারের মাস গড়ানোর পর তদন্ত নিয়ে পরিবার ও সহপাঠিদের অসন্তোষের মধ্যে বুধবার ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে একই তথ্য জানায় ডিবি ও র‌্যাব।

এই হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর রশীদ বিকালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফারদিন ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে এই ফারদিন আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে ডিবির ভাষ্য।

এরপর সন্ধ্যায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে একই তথ্য পাওয়ার কথা জানান এই ঘটনার ছায়া তদন্তে থাকা র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

ফারদিনের পারিবারিক সূত্র, তথ্য প্রযুক্তির বিশ্লেষণ, সিসিটিভি ফুটেজসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের আলোকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার কথা জানান তিনি।

ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে ডিবি ও র‌্যাবের ভিন্ন বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি বুয়েটে তার সহপাঠিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। এখন দুই সংস্থা থেকেই এক বক্তব্য এল।

Also Read: ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন: ডিবি

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন (২৪) বিতার্কিক ছিলেন। এই বছরই স্পেনের এক অনুষ্ঠানে তার যাওয়ার কথা ছিল। বাবা-মার বড় ছেলে ফারদিন থাকতেন ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে।

গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।

কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার পর তা জেনে খোঁজাখুজি করে ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়।

ফারদিনের লাশ পাওয়া যায় গোদনাইলে বর্ণালী টেক্সটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানায়।

তবে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। তার মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র৷

Also Read: বুয়েটছাত্র ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না

Also Read: বুয়েট ছাত্র ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

Also Read: সেই রাতে ৪ স্থানে ঘোরেন ফারদিন, যাত্রাবাড়ী থেকে ওঠেন লেগুনায়: ডিবি

Also Read: ফারদিন যাত্রাবাড়ী গেলেন, লেগুনায় উঠলেন, তারপর? তদন্ত গতিহারা

এরপর এই বুয়েটছাত্রের মৃত্যু নিয়ে তুমুল আলোচনা র মধ্যে ফারদিনের বাবা রামপুরা থানায় হত্যামামলা করলে তার তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবিকে। মামলায় নাম উল্লেখ থাকা একমাত্র আসামি ফারদিনের বান্ধবী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমাতুল্লাহ বুশরাকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

যেদিন ফারদিন নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বুশরার সঙ্গে ছিলেন তিনি। রাতে বুশরাকে রামপুরায় পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে আর পরিচিতজনরা দেখেনি।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৪ নভেম্বর বিকাল ৩টায় কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন। বিকাল আনুমানিক ৫টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে বুশরার সঙ্গে মিলিত হন তিনি। তারপর সেখান থেকে নীলক্ষেত ও ধানমণ্ডিসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে। সাত মসজিদ রোডে একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান।

রাত ৮টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে রিকশায় ফারদিন ও বুশরা রামপুরার দিক যান ফারদিন ও বুশরা। বুশরা বনশ্রীতে থাকেন।

রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা সেতুর কাছে রিকশা থেকে নেমে যান ফারদিন। এরপর কিছুক্ষণ রামপুরা সেতু এলাকায় একাকী ঘোরাফেরা করছিলেন বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে।

Also Read: ফারদিন খুন: বুশরা নিরাপরাধ, বলছেন চাচা

Also Read: ফারদিন হত্যা: বুশরা রিমান্ডে

মামলার তদন্তে নেমে ডিবি ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে রামপুরার পর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের উল্টো দিকে কেরানীগঞ্জে, সদরঘাটে, গুলিস্তানে এবং সর্বশেষ যাত্রাবাড়ীতে তার অবস্থান শনাক্ত করে।

গত ১৭ নভেম্বর ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেছিলেন, একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে ফারদিনকে রাত ২টায় যাত্রাবাড়ী থেকে রূপগঞ্জের তারাবগামী একটি লেগুনায় উঠতে দেখা গিয়েছিল।

কমান্ডার আল মঈন বলেন, “প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পরবর্তীতে (রামপুরার পর) ফারদিন কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড, গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় যান।

“সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় যে রাত ২ টা ১ মিনিটে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা হতে নিহত ফারদিনকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। রাত ২টা ২০ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের অপর পাশে তারাব বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা থেকে নেমে যায় ফারদিন।”

রাত ২টা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল সেতুর (ডেমরা সেতু)  তারাব প্রান্তে ফারদিনের অবস্থান শনাক্ত করে র‌্যাব। রাত ২ টা ৩৪ মিনিটে সেতুর মাঝ বরাবর তার অবস্থান পাওয়া যায়।

আল মঈন বলেন, “ব্রিজের তারাব প্রান্ত হতে মাঝখান পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার।

“রাত ২ টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস করে ফারদিন এবং রাত ২টা ৩৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে ব্রিজের উপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেয়।”

“ঝাঁপ দেওয়ার পর রাত ২টা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়ে ফারদিন আর রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। রাত ২টা ৫১ মিনিটে ফারদিনের হাতের ঘড়িতে পানি ঢুকে অকার্যকর হয়ে পড়ে,” বলেন তিনি।

তদন্তের উপসংহার টেনে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্যান্য সকল সংশ্লিষ্ট আলামত বিবেচনায় নিয়ে আমাদের তদন্তে বের হয়ে আসে যে, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ হতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে।”

তবে মামলার তদন্ত দায়িত্বরত তদন্ত কর্মকর্তাই করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ফারদিনের মৃত্যু সংক্রান্ত অন্য কোনো সূত্র বা আলামত পাওয়া গেলে, তবে তা বিবেচনায় নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।”

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মজিবুর রহমান এই মামলার তদন্ত করছেন। আগামী ১৫ জানুয়ারি আদালতে তার প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।