“বাসে আগুন দেখে কি আর কলিজায় পানি থাকে। রাস্তায় আর দাঁড়াইনি। যাত্রী নামাইছি আর উঠাইছি”, বলেন এক বাসচালক।
Published : 02 Nov 2023, 04:14 PM
অবরোধের শেষ দিন দেখে ভোরে বাস নিয়ে সড়কে নামেন চালক ওমর ফারুক, কিন্তু উত্তরায় বাসে আগুন জ্বলতে দেখে তড়িঘড়ি করে চলে আসেন সায়দাবাদে।
চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে গাজীপুর-সায়দাবাদ রুটে চলা বলাকা পরিবহনের এই চালক বলছিলেন, ‘চোখের সামনে বাসটা পুড়ে গেল’।
ওমর ফারুক জানান, বাসে আগুন দেখে গতি বাড়িয়ে দেন। সায়দাবাদ জনপথ মোড়ে এসে পৌঁছান সকাল সোয়া ৮টার দিকে।
তার কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনে সায়দাবাদ জনপথ মোড়ে বলাকা পরিবহনের অন্য যে বাসগুলো অপেক্ষায় ছিল, সেগুলোও আর সড়কে নামেনি। রাস্তার পাশে সারি করে রেখে হরতাল-অবরোধে জীবন-ঝুঁকি নিয়ে বাস চালানোর আলাপই করছিলেন তারা।
জানতে চাইলে চালক ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসটা আগুনে পুড়ে গেল। র্যাব আর পুলিশও আসছিল। ওই অবস্থা দেখে কি আর কলিজায় পানি থাকে? তাড়াতাড়ি চলে আসছি। রাস্তায় আর দাঁড়াইনি। যাত্রী নামাইছি আর উঠাইছি।”
সকালে উত্তরার আজমপুরে যখন বাসে আগুন জ্বলছিল, তখন গাজীপুরের দিকে ছুটছিল বলাকা পরিবহনের আরেকটি বাস। কিন্তু বাসে আগুনের ওই ঘটনা দেখে যাত্রীদের সেখানে নামিয়ে দিয়ে চালক বাস ঘুরিয়ে ফের চলে আসেন সায়দাবাদে।
বলাকা পরিবহনের সোহেল মিয়া নামে এক চালক বলেন, এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার আর বাস চালাবেন না।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধের প্রথম দুই দিনেও বাস চালাননি সোহেল। বাস মালিকের পিড়াপিড়িতে অবরোধের শেষ দিন সড়কে নামার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সহকর্মীর কাছ থেকে সকালে বাসে আগুনের খবর পাল্টে ফেলেন সিদ্ধান্ত।
সোহেল বলেন, “অনেক আশা নিয়ে বাস বের করছিলাম আজ। কিন্তু আগুনের ঘটনা শুনে আর চালামু না। আজমপুর থেকে বলাকা পরিবহনের যে বাস ঘুরে আসছে তাও আজ চলবে না।”
“প্রতিদিনই জনপথের মোড়ে আসি। ড্রাইভার ভাইদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে চলে যাই। আজকেও আর চালামু না। পেটের দায়ে তো আসছিলাম গাড়ি বের করতে, কিন্তু জীবনের কিছু হলে কেডা দ্যাখবে।”
রাজধানীর দক্ষিণের এলাকা মাতুয়াইল ও রায়ের বাগে বৃহস্পতিবার সকালে সড়কে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় অনেক বাস।
অবরোধের শেষ দিন যাত্রী বেশি হবে এমন প্রত্যাশা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা রোরাক পরিবহনের সহকারী চালক হৃদয় মোল্লা।
রায়ের বাগ এলাকায় বাস থামিয়ে যাত্রীর উদ্দেশে হাঁকডাক করছিলেন তিনি। কিন্তু আগ থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ বাস দেখে চালককে বলেন, “খাড়ায় কাম নাই, যাত্রী নাই। টান দেন।”
রায়ের বাগ থেকে বাসটিতে উঠে হৃদয় মোল্লার সঙ্গে কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। নারায়ণগঞ্জ থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত আসতে কোনো যানজটে পড়েননি জানিয়ে তিনি বলেন, “রাস্তা পুরাটা ফাঁকা। কোনো গ্যাঞ্জাম নাই। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ মোগড়া পাড়া থেকে আসছি ৪০ মিনিটে। যাত্রাবাড়ী থেকে গাড়ি ঘোরামু প্যাসেঞ্জার পাইলে।”
তৃতীয় দিনে যাত্রীর আশা করছিলেন বেশি, কিন্তু না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন হৃদয়। তার ভাষ্য, “মানুষ ভয়ে আছে। কুন সময় কী হয়।”
রায়ের বাগ এলাকায় গুলিস্তানমুখী শ্রাবণ, তারাবো ও সময় পরিবহনের বাসগুলো দাঁড়িয়ে ছিল বেলা ৮টার সময়। সাধারণত এই সময়ে বাস আসা মাত্র হুড়োহুড়ি করে যাত্রী উঠে পড়েন। বৃহস্পতিবার ছিল না সেই পুরনো চেহারা।
রায়েরবাগ, শনির আখাড়া ও কাজলায় থেকে বাসভর্তি যাত্রী নিয়ে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারে উঠে পড়ে বাসগুলো। কিন্তু অবরোধের তৃতীয় দিনে যাত্রীদের উপস্থিতি ছিল আগের দিনের চেয়ে কম।
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় গাজীপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী গাজীপুর পরিবহনসহ আরও কিছু বাস চলাচল করতে দেখা যায়। গুলিস্তান থেকে মগবাজার হয়ে সাতরাস্তা পর্যন্ত সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর পরিবহনের একটি বাসে দাঁড়ানো যাত্রী দেখা না গেলেও তিব্বত ও নাবিস্কো মোড়ে বাসটি যাত্রীতে ভরে যায়, যাদের বেশিরভাগই অফিস ও কর্মস্থলমুখী।
মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের সড়কে অবরোধের শেষ দিনেও যানজটের আগের চিত্র দেখা যায়নি। সকাল ১০টার দিকে এখান থেকে জামালপুরগামী রাজীব পরিবহনের একটি বাস ছেড়ে যেতে দেখা গেলেও বাস টার্মিনালের ভেতরে আর সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দূরপাল্লার বাসগুলো।
‘অবস্থা বুঝে সড়কে’
সায়দাবাদ ও যাত্রাবাড়ী বাস কাউন্টারগুলো থেকে বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণের পথে দুর পাল্লার বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি খুব একটা।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো শুক্রবার থেকে ছাড়ার কথা ভাবছেন কেউ কেউ, তবে সেটিও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পরবর্তী সিদ্ধান্ত বুঝে।
ঢাকার পাশের জেলাগুলোতে চলা কিছু ‘লোকাল বাস’ চলেছে অল্প যাত্রী নিয়ে। অবরোধ উঠলে সন্ধ্যায় বাস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে।
পটুয়াখালীর উদ্দেশে উত্তরা থেকে দুই জন যাত্রী নিয়ে সায়দাবাদে এসেছিল লাবিবা পরিবহনের একটি বাস। কিন্তু সায়দাবাদে আর যাত্রী না পাওয়ায় যাত্রী দুজনকে অন্য বাসে তুলে দিয়েছেন চালক ও সহকারীরা।
বাসটির সায়দাবাদ কাউন্টারের ব্যবস্থাপক নাইম ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউন্টার খুলেছি আজ। যাত্রী দুইজন হওয়ায় মালিকের সঙ্গে কথা বলে বাস টার্মিনালে পাঠিয়ে দিয়েছি। দুই জন যাত্রীকে আমরা অন্য বাসে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন যাত্রী পাইলে বাস চালাব।”
সায়দাবাদ থেকে বৃহস্পতিবার বাস না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্যামলী পরিবহনও। সন্ধ্যায় পরিস্থিতি বুঝে বাস চালানোর কথা জানিয়েছেন কাউন্টারের টিকেট বিক্রয় কর্মী রায়হান ইসলাম।
“অবরোধ না ওঠা পর্যন্ত কোনো এসি বাস চালাবে না কেউ। আজকে অবরোধ শেষ হলে শুক্রবার এসি বাস নামবে।”
যাত্রাবাড়ী থেকে যশোরগামী ডিএম পরিবহনের একটি বাসের চালক লিটন সরদার বলেন, “দেড় ঘণ্টা লাগছে ৩১ জন যাত্রী পাইতে। সিট ৬১টা থাকলেও অর্ধেক যাত্রী নিয়া রওয়ানা দিতাছি। রাস্তায় পাইলে লমু।”
অবরোধেও বাস চালানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাস্তা তো খালি। সমস্যা নাই, গাড়ি না চালাইলে খামু কী।”
ঢাকা থেকে ফরিদপুরগামী গেল্ডেন লাইন পরিবহনের যাত্রাবাড়ী কাউন্টারের বিক্রয়কর্মী বাদল মিয়া বলেন, “সকাল ৭টায় একটা বাস গেছে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। সব বাস তো নামেনি। সব ড্রাইভারও যাইতে চায় না। আর যাত্রীও নাই।”
শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা ও যশোরগামী বিভিন্ন বাসের টিকেট কাউন্টারে কমিশনের মাধ্যমে বিক্রি করেন নাসির উদ্দিন। আন্তঃজেলা ‘লোকাল’ বাসগুলো যেতে চাইলেও অর্ধেক যাত্রী পেতে দুই ঘণ্টার মত সময় লাগছে বলে জানান তিনি।
অপরদিকে যাত্রবাড়ী, শনির আখড়া, কাজলা ও সায়দাবাদে অবরোধের প্রথম দুই দিনে তৎপরতা না দেখা গেলেও শেষ দিনে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকার মূল সড়কে সকালে জড়ো হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। কিন্তু টহল পুলিশের উপস্থিতি দেখে তারা স্থান ত্যাগ করে। সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে।