তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির এই সুবিধা নিয়ে টিকেট কালোবাজারির অভিযোগও আছে। তাছাড়া স্মার্টফোন নেই, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান কম; এমন মানুষরা এখনও অনলাইনে টিকেট কিনতে পারেন না।
Published : 19 Mar 2025, 11:40 PM
ঈদের আগে রেল স্টেশন, বাস টার্মিনালে যাত্রীদের ভিড়, টিকেট বিক্রেতাদের হাঁকডাক, টিকেট কালোবাজারে বিক্রি- এসব ঘটনা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল মানুষের।
তবে গত দুই বছরে সেই দৃশ্য অনেকটাই পাল্টে গেছে। এর মূলে রয়েছে অনলাইনে টিকেট বিক্রি বা ই-টিকেটিং।
ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু হওয়ায় ঈদের আগে বাস, ট্রেনের টিকেটের জন্য কাউন্টারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে না এখন। যাত্রীরা টিকেট কিনতে পারছেন ঘরে বসেই।
তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির এই সুবিধা নিয়ে টিকেট কালোবাজারির অভিযোগও আছে। তাছাড়া স্মার্টফোন নেই, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান কম; এমন মানুষরা এখনও অনলাইনে টিকেট কিনতে পারেন না। যাত্রীরা বলছেন, বিষয়গুলোর সমাধান করতে পারলে ই-টিকেটিংয়ের সুফল পাবে সবাই।
দেশে ২০২৩ সাল থেকে রেলের টিকেট বিক্রির কার্যক্রম পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে আন্তঃনগর ট্রেনের ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি টিকেট অনলাইনে বিক্রি হয়। লোকাল, মেইল ট্রেনের টিকেট অনলাইনে দেওয়া হয় না।
আর অনলাইনে বাসের টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে আরও আগে; ২০০৮ সালে সোহাগ পরিবহন বাসের টিকেট অনলাইনে বিক্রি শুরু করে।
তবে ‘সহজ ডট কম’ অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাসের টিকেট বিক্রি আরও বড় পরিসরে শুরু হয় ২০১৪ সালে। এখন সহজ ছাড়াও যাত্রী, বাস বিডি, বিডি টিকেটস, পরিবহন ডটকমসহ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বাসের টিকেট বিক্রি করছে।
প্রতিদিন কত পরিমাণ টিকেট অনলাইনে বিক্রি হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ‘সহজ’ জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১০ কোটির বেশি টিকেট বিক্রি করেছে। এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭০ শতাংশ টিকেট এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি হয়।
আর সারাদেশের তিন হাজার রুটের সাড়ে সাত হাজারে বেশি বাস কাউন্টার এবং একশর বেশি শতাধিক বাস কোম্পানি যুক্ত আছে ‘সহজ’র সঙ্গে।
নেই হাঁকডাক
এ বছর ২৪ মার্চ থেকে ঈদযাত্রা হিসাব করে ১৪ মার্চ অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বাসের অগ্রিম টিকেটও বিক্রি শুরু হয়েছে ওইদিন। সে হিসাবে বুধবার বিক্রি হচ্ছে ২৯ তারিখ যাত্রার টিকেট।
কয়েকবছর আগেও ঈদের সময় কাউন্টারে টিকেট বিক্রির সময় কমলাপুর স্টেশনে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। টিকেট প্রত্যাশীরা আগের দিন এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
তবে বুধবার সকালে কমলাপুর স্টেশন পুরোপুরি ফাঁকা দেখা গেছে। স্টেশন প্রাঙ্গন পুরোপুরি শান্ত, কোনো কোলাহল নেই। কাউন্টার থেকে চলতি যাত্রার টিকেট কিনছিলেন কিছু যাত্রী।
ঈদে দেওয়ানগঞ্জ হয়ে গ্রামের বাড়ি যান কুড়িগ্রামের রাজিবপুরের হুমায়ুন কবির। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবার অনলাইনে ঈদের অগ্রিম টিকেট কিনতে পারেননি। তবে অনলাইনে টিকেট বিক্রির পদ্ধতি তার কাছে ভালো মনে হয়েছে।
“অনলাইনে মুহূর্তের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে যায়। আগে কাউন্টারে সবার আগে থাকতে পারলে নিশ্চয়তা থাকত যে টিকেট পাব। তবে সেজন্য পরিশ্রম করতে হত অবর্ণনীয়। আগের দিন গিয়ে বসে থাকা, ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, বাথরুমের কষ্ট। কিন্তু অনলাইনে টিকেটের নিশ্চয়তা না থাকলেও তেমন কষ্ট নাই। কারণ কেউ না কেউ তো পাচ্ছেই।”
কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, ই-টিকেটিংয়ের কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে, স্বস্তিতে আছেন তারাও।
“আগে যেটা হত আগে টিকেট দেওয়ার দুইদিন আগেও লোকজন স্টেশনে এসে বসে থাকত। আমাদের লাউঞ্জে অল্প একটু জায়গা, লাইন চলে যেত এক কিলোমিটার পর্যন্ত। এখানে থেকে লোকজনের চরম দুর্ভোগ, পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে স্টেশনে আসা-যাওয়ার সময়, খরচও ছিল। এখন এগুলো নাই। আমাদেরও ঝক্কি অনেকটা কমে গেছে, টিকেটের জন্য কেউ আব্দার করে না।”
ঈদের টিকেট বিক্রি শুরুর পর গত কয়েকদিন গাবতলী ও কল্যাণপুর এলাকার কাউন্টারগুলোর সামনেও যাত্রীদের ভিড় দেখা যায়নি।
গাবতলীতে ঈদের অগ্রিম টিকেটের জন্য সবচেয়ে বেশি ভিড় হত হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে। টিকেট প্রত্যাশীদের জন্য বাড়তি চেয়ার, রোদ থেকে বাঁচাতে সামিয়ানার ব্যবস্থা করা হত।
মঙ্গলবার দেখা গেছে, হানিফ কাউন্টারের সামনে ঈদ টিকেট বিক্রির একটি ব্যানার টানানো। তবে যাত্রী ভিড় নেই। দুয়েকজন এসে চলতি যাত্রার টিকেট কিনছেন।
নুরুল ইসলাম নামে একজন বিক্রয়কর্মী বললেন, অনলাইনে টিকেট বিক্রি শুরুর পর থেকে চিত্র পুরোই পাল্টে গেছে।
“আগে এখানে লোকজন ভরপুর থাকত। এখন এই চাপ নাই। অনলাইন করে দিছে, আমাদের কাউন্টার থেকেও টিকেট নিতে পারতেছে, আবার বিভিন্ন সাইট থেকেও টিকেট কিনতে পারছে যাত্রীরা।”
হানিফ এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম রিকু বলেন, কোভিড সংক্রমণ শুরুর পর ২০২১ সাল থেকে বাসের টিকেট অনলাইনে বিক্রি করছেন তারা। হানিফ এন্টারপ্রাইজের নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং টিকেট বিক্রির বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রির জন্য টিকেট দেন তারা।
রিকু বলেন, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মোট টিকেটের ৮০ শতাংশ অনলাইন থেকে দেওয়া হয়। ২০ শতাংশ টিকেট কাউন্টারের জন্য রাখেন।
“অনলাইনে সেল ভালোই হচ্ছে। কেউ এখন আর কষ্ট করে কাউন্টারে আসতে চাচ্ছেন না, ঘরে বসে টিকেট কাটতেছে। আমাদেরও হেসেল অনেক কমেছে।”
ঝামেলা এড়াতে এখন আর কাউন্টারে যান ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌস।
“কাউন্টারে টিকেটের জন্য ভোরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও টিকেট পাওয়া যায় না। এ কারণে এখন অনলাইনে টিকেট কিনি। অনেক সময় পাওয়া যায়, অনেক সময় পাওয়া যায় না,” বলেন তিনি।
প্রতি ঈদেই ঢাকা থেকে দিনাজপুর যান বেসরকারি চাকুরে মেহেদী হাসান। আগে বাস কাউন্টারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত তাকে। অনলাইন টিকেটিংয়ের কারণে এখন সে ভোগান্তি নেই।
মেহেদী বলেন, “সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আর কাউন্টার পর্যন্ত যাওয়া-আসায় বাড়তি সময়, অর্থ খরচ হত যেটা এখন লাগে না। আমি এখন ঘরে বসেই টিকেট নিতে পারছি। আমার ইচ্ছেমত বাছাই করে টিকেট নিতে পারছি।”
আছে কালোবাজারির সুযোগ, ঠেকানোর উপায় কী?
ট্রেনে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সর্বোচ্চ চারটি টিকেট কেনা যায়। তবে বাসের টিকেটের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয় না। একবার লগইন করে একজন যাত্রী সর্বোচ্চ চারটি টিকেট কিনতে পারেন। এভাবে একজন যতবার খুশি ততবার পরিবহন কোম্পানি বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে টিকেট কিনতে পারেন।।
এতে বাসের টিকেট কালোবাজারির সুযোগ বেশি বলে মনে করেন আরিফুল ইসলাম। আরিফুল প্রতি ঈদে গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট যান।
তার ভাষ্য, “ঈদের সময় একসঙ্গে অনেক মানুষের টিকেট প্রয়োজন হয়। সে কারণে বাস বা ট্রেনের টিকেটের একটা বড় অংশ কালোবাজারে চলে যায়। কিছু মানুষ অনেক টিকেট নিয়ে রাখে। পরে তারা নানা মাধ্যম ব্যবহার করে ওই টিকেট বিক্রি করে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসলে সরকারের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। বেশি দামে বিক্রি হয়।
“এই দুইটা জায়গায় এমন সিস্টেম করা দরকার যাতে কেউ বাড়তি টিকেট কিনে রেখে দিতে না পারে। সরকার এখনও এই জায়গায় নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। বাস, বিমান, রেল সব জায়গায় একই অবস্থা। প্রয়োজন বাড়লেই টিকেট উধাও।”
‘সহজ’ এর পরিচালক (টিকেটস) শাকিল জাওয়াদ রাহিম বলেন, এখন কাউন্টার থেকে যে টিকেট দেওয়া হয় সেগুলো অনলাইন থেকেই ছাপানো। ফলে সব টিকেট একই প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে।
“আপনি যদি কাউন্টারে একটা সিটের ওপর ক্লিক করেন সেটা অনলাইনে সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ হয়ে যায় অথবা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে যদি করা হয় সেটি কাউন্টারেও বুকিং হয়। এ কারণে মিসইউজ কমে গেছে। এখন টিকেট ধরে রাখার সুযোগ নাই।”
রাহিম মনে করেন, ঈদের আগে যাত্রীর চেয়ে টিকেট বেশি থাকে। তারপরও নানা কারণে বাসের টিকেট কালোবাজারি করার সুযোগ কম।
“বাসের সংখ্যা এখন অনেক বেশি বেড়েছে, মানুষের অপশন বেড়েছে। আগে সবাই একদিনে টিকেট ছাড়লেও এখন একেক পরিবহন একেক সময় টিকেট অনলাইনে ছেড়ে দেয়। এতে একদিনে চাপ তৈরি হয় না। মালিকরা অনেক সচেতন, তারা কোনো টিকেট বুক করে রাখে না। ঈদের সব টিকেট অফেরতযোগ্য, কেউ বাড়তি টিকেট কিনে রাখলেও সেটি বিক্রি অনিশ্চিত। এই ঝুঁকি নিতে চায় না। এসব কারণে কালোবাজারি করা কঠিন হয়ে গেছে এখন।”
কালোবাজারিরা বিভিন্ন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একাধিক টিকেট কিনে তা বেশি দামে বিক্রি করে। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় আপাতত রেলের সিস্টেমে নেই।
“কেউ একজন ১০টা (এনআইডি) ম্যানেজ করে টিকেট করলে সিস্টেমে তাকে আটকানো যাবে না। তবে যার আইডি সে টিকেট কিনে ভ্রমণ করছে কি না সেটা নিশ্চিত করতে আমরা গেটে চেক করতে পারি। এটা করতে গেলে আবার সময় বেশি লাগবে, অনেকেই ট্রেন ধরতে পারবেন না।”
তিনি বলেন, “তবে অনলাইনে টিকেট বিক্রির কারণে জালিয়াতির সুযোগ কমে এসেছে। যে কালোবাজারি করবে তাকেও তো অনলাইনে অন্য সবার মতোই টিকেট কিনতে হবে। সে যে বাড়তি সুযোগ পাবে এমন না।
আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের ভাষ্য, বিভিন্ন বাস অপারেটর টিকেট বিক্রি করে তাদের নিজস্ব সফটওয়্যারে। অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের সফটওয়্যারও আলাদা। সেখানে বিআরটিএর হস্তক্ষেপ করা বা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই।
“তবে আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা টিকেট বিক্রি করছে তাদের বলে দিতে পারি তারা যেন রেলের মতো সিস্টেম করে। যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, একটি এনআইডির বিপরীতে চার বা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি টিকেট কিনতে না পারার ব্যবস্থা রাখে। এটা করতে পারলে অনিয়ম অনেকটাই দূর হবে।”