“একবার মনে হয় ভালো সময় আসবে, আবার মনে হয় খুবই খারাপ সময় অপেক্ষা করছে”, বলেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
Published : 01 Jan 2025, 01:14 AM
কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেওয়া গণআন্দোলন ঘিরে অনেক কিছুই বদলে গেছে বাংলাদেশে। যে শাসক, যে কাঠামো, যে ছকে দেশ চলছিল, সেগুলোর সবই ওলটপালট।
এই পরিবর্তন দেশের ‘সব কিছু’ ঢেলে সাজানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে কেউ কেউ আশাবাদী হতে পারছেন না; তারা ‘খারাপ কিছু’ কিংবা ‘সব কিছু আগের মত চলার’ আশঙ্কাও দেখছেন।
পরিবর্তিত বাংলাদেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে অন্তর্বতী সরকার। গত অগাস্টে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত।
“আমাদের লক্ষ্য একটাই— উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার; আমাদের এক লক্ষ্য।”
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ‘বৈষম্যহীন সমাজ’ প্রতিষ্ঠার আশা নিয়েই দেশের মানুষ সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে নতুন বছরে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি নিয়ে, ভোট নিয়ে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে আলাদা আলাদা প্রশ্ন আর প্রত্যাশা থাকবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতির ছক কিংবা ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনীতির সঙ্গে আছে ভোটের প্রসঙ্গও।
ভোট কবে— সে প্রশ্ন শেখ হাসিনা পতনের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু দিনক্ষণের সামনে শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্কার।
সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রপরিচালনার প্রায় সব পদ্ধতির সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সংস্কার ভোটের আগে কতটুকু হবে আর পরে কতটুকু হবে, সেই প্রশ্নও উঠে গেছে।
সংস্কারের নানা প্রস্তাব আসছে সরকারের বাইরে থেকেও। এমন প্রস্তাব আছে, যেখানে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘পূর্ণক্ষমতাসম্পন্ন সরকার’ ঘোষণা করার কথা বলা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিদায়ের পর অর্থনীতির বড় বড় ক্ষত ভেসে উঠেছে। সেই ক্ষত ২০২৫ সালে কতটুকু সারবে, সেটাও দেখার অপেক্ষায় থাকবে মানুষ।
অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর প্রশ্নে রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতিকে সামনে আনছেন অনেক বিশ্লেষক। তারা বলছেন, রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ানো গেলে নতুন বছরে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে। তবে এ ক্ষেত্রেও সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন কেউ কেউ।
মূল্যস্ফীতি কমাতে জ্বালানি পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশপাশি কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শও এসেছে।
রাজনীতিতে ভিন্ন বাস্তবতা
স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে কিনা, সেটা নিয়েই অনিশ্চয়তা আছে।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন; তার দল আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা হয়ত পলাতক, না হয় কারাগারে।
দেশের অন্যতম পুরনো এ দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবি তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন সরকার যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল, এখন সেই আদালতের কাঠগড়াতেই দাঁড় করানো হয়েছে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের।
মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্রলীগের রাজনীতি।
আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ হওয়ার অভিযোগে একই বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পার্টিসহ বিগত সরকারের বেশ কয়েকটি শরিক দল।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হয়েছেন। একের পর এক মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও এখনও দেশে ফেরা হয়নি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের।
আওয়ামী লীগের ‘অবর্তমানে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে দেশের রাজনীতির মঞ্চে নতুন দল আসার খবর শোনা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ‘সুবিধাজনক’ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়েছে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতির জন্য কী অপেক্ষা করছে, সেই প্রশ্ন আছে জনমনে।
সামনের সময়টা ‘ভালো খারাপ’ দুটোই ঘটতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিনিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “একবার মনে হয় ভালো সময় আসবে, আবার মনে হয় খুবই খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।”
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটকে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ববি বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “রাজনীতির পুরনো সমীকরণে দলমত নির্বিশেষে একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়ির চর্চা হয়ে আসছিল।
“অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এই চর্চা কমলেও দু-একটি সংগঠনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, সরকাবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা থাকায় তাদের প্রতি জনগণকে প্রশ্নাতীত পক্ষপাত থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “এটি আওয়ামী ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।নতুন ধরনের রাজনীতি যাকে বলছি, তা আদতে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’।”
তবে নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী হতে চান জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মীর আরশাদুল হক। তিনি বলেন, “এখন সহজেই জনগণকে ভুল বোঝানো যাবে না।
“সাধারণ জনগণ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে খোঁজ রাখেন। সেক্ষেত্রে পুরনো ধাঁচের রাজনীতি করে টেকা মুশকিল হবে।”
তিনি বলেন, “নতুন বছরে তরুণদের প্রতি প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকবে। নতুন ও তুলনামূলক ছোট কিন্তু প্রগতিশীল ধারার দলগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।
“আর বড় দলগুলো পুরনো মোড়ক থেকে বেরোতে না পারলে সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগের মত অবস্থা হতে পারে।”
নতুন বছরে মাঠের রাজনীতি কেমন থাকবে, সেই আভাস দিতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে।
রাজনৈতিক সচেতন অনেক মানুষ আছেন, যারা ভোটের জন্য তাড়াহুড়া করার বিপক্ষে।
কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার মনে করেন, “অধ্যাপক ইউনূসের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। তার মানে হল, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা উপদেষ্টা সরকার না বানিয়ে পূর্ণক্ষমতাসম্পন্ন সরকার হিসেবে ঘোষণা দেব।
“রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই এটা করতে হবে, যেন অন্তর্বর্তী পর্যায়টা আমরা কাটাতে পারি। আমি এখন নির্বাচনের পক্ষে নই।”
অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলা নিয়ে আশাবাদী জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মীর আরশাদুল হক। তিনি বলেনন, “চব্বিশ যে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে, তা পঁচিশেও চলমান থাকবে, অর্থাৎ বদলের এই ধারা অব্যাহত থাকবে৷
“বাংলাদেশ উন্নত হবে সব দিকেই, এইটাই এখানকার জনগণের সিদ্ধান্ত।”
ভোট কবে?
দেশের পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে — নতুন বছরে এই প্রশ্নই রাজনীতিতে বেশি উচ্চারিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা দিলেও এখনও তা সুনির্দিষ্ট করেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে ভোট করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষ দিকে হয়ত সম্ভব হবে।
“আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
তবে সরকারপ্রধানের এমন ঘোষণা আশ্বস্ত হতে পারেনি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। গত ২১ ডিসেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যেই হতে হবে। এর মধ্যেই শেষ করতে হবে সব সংস্কার।”
অন্যদিকে বিএনপি ভোটের দাবিতে জনগণকে আবার আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর ঠাঁকুরগাওয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ওই যেমন ৫ অগাস্ট ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, ঠিক সেইমত ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে।
“রাস্তায় নামতে হবে অধিকার আদায়ের জন্য, ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য, ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য, সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য জন্য, নিজের অধিকার আদায়ের জন্য।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর এমন চাপের ওপরও ভোটের দিনক্ষণ নির্ভর করবে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “জনগণের চাপ থাকলে সময়সীমা ঠিক থাকবে, নয়ত থাকবে না। কথায় বলে না কুকুরের লেজ বাঁশের চোঙ্গায় ঢুকালেও বাঁকাই থাকে। এখানকার সমাজব্যবস্থাটাই এমন যে, যত চেষ্টাই করুক জনগণের চাপ না থাকলে বাঁকাই থাকবে।”
সংস্কারের জন্য ‘যুক্তিসঙ্গত’ সময়ের যে কথা অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেলিম বলেন, “তারা বলে যুক্তিসঙ্গত একটা সময় দরকার। কিন্তু এত দিন তো লাগার কথা নয়। মানুষ তো এত বোকা নয়, অনেকে মনে করেন তারা কিংস পার্টি করতে চায়, সেজন্য একটু বেশি সময় নেওয়ার ইচ্ছা।
“অন্যদিকে বিএনপিপন্থিরা ভাবছেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে ভোট করছিল, আমরা একেবারে সেভাবে ভোট করে ক্ষমতায় চলে আসব, সময় দেওয়ার দরকার নাই।”
সংস্কার ভোটের আগে না পরে?
রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন, বড় ধরনের সংস্কার নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই করা হোক।
দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এরপর গঠন করা হয় আরও পাঁচটি কমিশন।
প্রথমে গঠন করা ছয়টি কমিশন চলতি মাসের শেষ বা জানুয়ারির প্রথম দিকে প্রতিবেদন জমা দেবে। এই তালিকায় রয়েছে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।
পাঁচটি কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি হয় ৩ অক্টোবর। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয় ৭ অক্টোবর। গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে এসব কমিশনকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এরপর গত ১৭ অক্টোবর আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানায় সরকার। সেগুলো হল স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। তবে এসব কমিশন পূর্ণাঙ্গ হতে এক মাস লেগে যায়।
অধ্যাপক ইউনূসকে সমর্থন দেওয়া দলগুলো সংস্কারে সময় দেওয়ার কথা বললেও দ্রুত নির্বাচনের দাবিও জানিয়ে আসছে।
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক আবুল কাসেম ফজলুল হক মনে করেন, “কেবল একটি নির্বাচন আয়োজন নয়, অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পথ ধরে সংস্কার কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের বেশ কিছু সংস্কার দরকার। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেসব সংস্কার করেনি বলেই এটা দরকার।
“আমাদের নীতিগত বা বোধ তৈরির কাজটিও করত হবে, যা দীর্ঘ সময়েও হয়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে, অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে হবে, বাজারব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে।”
তবে সংস্কারের জন্য যে অকাট্য রাজনৈতিক ও জনসমর্থন দরকার, তা না থাকায় এই মহাযজ্ঞ বাস্তবায়ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করছেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “বর্তমান সরকার কী সংস্কার করবে! তারা তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
“২০০৭-২০০৮ সালে দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। দুই বছরেও যেহেতু তারা পরিবর্তন আনতে পারেনি, ফলে পরের সরকারের সময়েও দেশ আগের মতই চলেছে।”
তিনি বলেন, “এই সরকার পারবে কিনা আমি জানি না। আগের সরকার তো তাও ডিসিপ্লিনড ছিল, এখন তো সেটাও দেখছি না।”
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মীর আরশাদুল হক বলেন, “জাতীয় সংস্কার একটা ধীরগতির বিষয়, তবে ছোট ছোট বিষয় থেকে বড় সব ধরনের সংস্কার দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে।
“একটা বড় সংস্কার প্রয়োজন আমলাতন্ত্রে, এটি হবে কিনা তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশ সংস্কারের ভেতর দিয়েই এগিয়ে যাবে এখন থেকে, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত জনগণই। ভালো কিছুই হবে বলে আশা করা যায়।”
মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশী কবির বলেন, “সংস্কারের জন্য কমিশনগুলো যে প্রতিবেদন দেবে, সেগুলো কিন্তু জনগণের কাছেও থাকতে হবে। শুধু কয়েকজনের কাছে এবং কেবিনেটের কাছে থাকলেই চলবে না।
“নির্বাচিত সরকার ছাড়া আইন পরিবর্তন করা যাবে না। মূল বিষয়গুলোর পরিবর্তন হবে তখনই, যখন একটা নির্বাচিত সরকার আসবে।”
সংস্কারের প্রশ্নে ফরহাদ মজহার মনে করেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে আমরা একটা রিকনস্ট্রাকশন বা রিকন্সিলেশন কাউন্সিল গঠন করতে পারি।
“আমাদের মধ্যে যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছে, আমরা যে বিভক্ত হয়ে আছি, এটা যেন দ্রুত কাটাতে পারি; নিরাময় করতে পারি।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের মধ্যেও তো ভালো লোক আছে। তাদের যেন বিভক্ত না করি। তার জন্য একটা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কাউন্সিল গঠন করতে পারি। এই কাউন্সিল নজরদারি করবে যে সরকার জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করছে কিনা।”
এবং অর্থনীতি?
রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ভর করে চলা সামষ্টিক অর্থনীতিতে দুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে আছে ঊচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা নতুন বছরের শুরুর কয়েক মাসও থাকবে বলে আভাস দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে পারলে রিজার্ভ সংকট দূর করার পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সংস্কার কার্যক্রমের কিছুটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলেও অর্থনীতি একটা কাঠামোয় আসবে; অগোছালো থেকে শৃঙ্খলায় আসবে।”
রপ্তানি ও রেমিটেন্স এখনও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রিজার্ভ এখনও প্রয়োজনের তুলনায় নিচের সূচকে।
“আশার দিক হল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সরকারের সঙ্গে ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে দাতা সংস্থাগুলোর। সরকার এদিক দিয়ে ভালো করছে।”
এসব অর্থ ছাড় হলে সংকট কেটে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে চলে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি গত মার্চ থেকে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত নভেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠে যায় ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, “অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, পরে লাগবে বা খরচ বেশি দেখানো হয়েছে; এসব প্রকল্প থেকে অন্তত ৮ শতাংশ যদি কমানো যায়, তাহলে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় থাকা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ করা সম্ভব। কিংবা যারা আছে, তাদের সুবিধা বাড়ানো যাবে।”
নতুন বছরে জ্বালানি পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো তৌফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “সরকার যদি কঠিন পদক্ষেপের মাধ্যমে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল ও বিদ্যুতের দাম ঠিক রাখতে পারে, তাহলে ব্যবসায়ীদের কর ছাড় কমিয়ে দিলেও তারা পুষিয়ে নিতে পারবেন।”
সামগ্রিক বিচারে অর্থনীতি ভালোর দিকে যাচ্ছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউসুফ বলেন, “অনেকটাই স্বস্তি দেখাতে পারছে সরকার। সদিচ্ছার সঙ্গে সরকারের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।
“ব্যবসায়ীরা যদি রাজনীতির উপর নির্ভরশীলতা কমান, তাহলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে তো খুব একটা ভাবতে হবে না। তাদের কাজ ব্যবসা করা, সরকার যেই আসুক তারা ব্যবসা করবে।”
মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক হুমায়রা ফেরদৌস।
তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপ না কমা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা না ফেরায় সামনের দিকে বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্য সংস্থান। উৎপাদন বাড়াতে না পারলে সমস্যা আরও বাড়বে। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে যে-করেই হোক।”
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালের শুরুতেও চাপে থাকতে পারে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। রিজার্ভ বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে সরকারকে বিনিময় হার পুরোটা বাজারভিত্তিক করতে ফের জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বিনিয়োগ ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে সরকারের ‘সমন্বিত উদ্যোগ’ নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন সিপিডির তৌফিকুল ইসলাম খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভঙ্গুর একটা অথর্নীতি পেয়েছে সরকার। তা ব্যাংক বলেন, পুঁজিবাজার বলেন আর রিজার্ভ বলেন, সব জায়গায় বিশৃঙ্খলা ছিল।
“এজন্য কঠিন পদেক্ষেপে সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর ছাড় কমিয়ে দেওয়ার দিকে যাচ্ছে।”
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, “২০২৫ সালে এসব সংস্কারের মাধ্যমে একটি কাঠামোতে যাবে আর্থিক খাত। যার সুবিধা পরবর্তী বছরে পাওয়া যাবে। এখন ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে সরকারকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।“
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়, যা এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, শ্রম-অসন্তোষ না থাকলে তৈরি পোশাক রপ্তানি আরো বাড়বে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ নানা অপরাধ বিচারের আওতায় আনতে কাজ করার কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মীর আরশাদুল হক বলেন, “লাখো কোটি টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার মাধ্যমেই প্রমাণ হয়, বিদায়ী সরকারের ন্যূনতম দেশপ্রেম ছিল না। সেই ধকল কাটিয়ে ওঠা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ২০২৫ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।”
স্বস্তি ফিরবে তো?
জুলাই-অগাস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নির্বিচার বলপ্রয়োগ ও প্রাণহানির কারণে জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ। থানা ও ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়।
সরকারের পতনের পর প্রায় এক সপ্তাহ ‘কর্মবিরতি’ পালনের কথা বলে কাজে যোগ দেয়নি পুলিশ। এরপর ক্রমান্বয়ে পুলিশ কাজে ফিরতে শুরু করলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে শুরুর দিকে ব্যাপক আকারে ‘মব জাস্টিস’ চলে; এখন পরিস্থিতি বদলাতে থাকলেও চুরি-ছিনতাই থামছে না।
এমন অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন মাঠে; গ্রেপ্তার ও তল্লাশিসহ বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তিন বাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় খোদ অন্তর্বর্তী সরকারও। গত ১৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ের চেয়ে ‘অনেকটা উন্নতি’ হলেও জনগণের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছয়নি।
পুলিশের নির্লিপ্ততায় চাঁদাবাজি ও দখলের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসছে; চাঁদাবাজ পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি আগের মত চলার অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
সরকার পরিবর্তনের সাড়ে চার মাসেও যে পুলিশিং কার্যক্রমে গতিশীলতা ফেরেনি, তা স্বীকার করে আইজিপি বাহারুল আলম সম্প্রতি বলেন, “৫ অগাস্টের পর পুলিশের সম্পত্তি ও জীবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারের সহায়তায় আমরা পুলিশের অপারেশনাল কার্যক্রমে গতিশীলতা নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।
“দেশের জনগণের সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ দুরূহ। আমি সবিনয়ে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।”
কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে সারাদেশে ‘চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই’ বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
২৩ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আজ চার মাস, সাড়ে চার মাস হতে চলল, কেন ছিনতাইকারী বাড়বে? ছিনতাইকারীর ছুরিতে ৯ জন ঢাকায় মারা গেল।”
নতুন বছরে ‘সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে’ আসুক, এমন আশা প্রকাশ করে খুশী কবির বলেন, “আশা করি দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দামের পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
“তবে সরকারে এখন সবকিছু যেভাবে লাগামহীন চলছে; একে গ্রেপ্তার করছে, ওকে গ্রেপ্তার করছে, সরকারের একেকজন একেকভাবে কথা বলছেন, এগুলো বন্ধ করতে হবে। যে দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে, সে দেশের স্বপ্ন যেন বেঁচে থাকে।”