ঢাকার মিরপুর রোডে সুকন্যা টাওয়ারের কাছে বিকট বিস্ফোরণে আংশিক ধসে পড়া শিরিন ভবনের দোকানিরা এখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি, তবে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে আশপাশের মার্কেটগুলো।
তিন তলা শিরিন ভবনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ২৪ ঘণ্টা পরও ভবনটির সামনের রাস্তায় রয়ে গেছে রক্তের ছাপ।
সোমবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের আশপাশে ব্যারিকেডে দিয়ে রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, যেখানে রক্তের ছাপ দেখা যাচ্ছে, সেখানে রোববার বিস্ফোরণের পর উপুড় হয়ে পড়ে ছিল মানুষ।
ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে শিরিন ভবনের দেয়াল ধসে রাস্তায় পড়লে তিনজনের মৃত্যু হয়, আহত হন প্রায় অর্ধশত মানুষ। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আধা কিলোমিটার দূরের ভবনও কেঁপে ওঠে।
ভবনটির নিচতলায় আটটি পাঞ্জাবির দোকান রয়েছে। তার মধ্যে মেহেদী পাঞ্জাবি ঘরে কাজ করেন আব্দুর রাজ্জাক। রোববার বেলা ১১টার দিকে যখন বিস্ফোরণ ঘটে, তখন তিনি এবং আরেক কর্মচারী হালিম দোকানে এসেছিলেন, মালিক মো. রফিক তখনও পৌঁছাননি।
“হালিম তখন ছিল দোতলায়, টয়লেটের ভেতরে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ও সামান্য আহত হয়েছে। আর আমি ছিলাম দোকানের সামনে রাস্তায়।”
হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর প্রথমে পূর্ব দিকের দেয়াল ধসে রাজ্জাকের ওপর পড়তে শুরু করে। তারপর উত্তর ও পশ্চিম পাশের দেয়ালও ধসে পড়ে।
রাজ্জাক বলেন, “প্রশাসন কী সিদ্ধান্ত নেয় জানি না, দোকানে আমাদের অনেক মালামাল রয়েছে।”
দোতলার 'নিউ মডেল লন্ড্রির' মালিক আব্দুল আল মামুন জানান, বিস্ফোরণ যখন হয়, তখনও তিনি দোকানে আসেননি। আর কর্মচারী আজাদ নাস্তা খেতে বাইরে গিয়েছিল।
সাড়ে ৯ হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি চালাতেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, এখন কোথায় গিয়ে আবার শুরু কবর বুঝতে পারছি না।”
ভবনটি 'ঝুঁকিপূর্ণ’, এর পর কী
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে 'ঝুঁকিপূর্ণ ভবন' ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত ডিএসসিসি'র আঞ্চলিক কমিটি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীনের নেতৃত্বাধীন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত আঞ্চলিক কমিটিরর মাধ্যমে এ ঘোষণা দেওয়া হয় বলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান।
তিনি বলেন, “আঞ্চলিক কমিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বাধীন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত ডিএসসিসির টেকনিক্যাল কমিটিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। টেকনিক্যাল কমিটি এ ভবন নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”
করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন বলেন, "বিস্ফোরণে ভবনটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আঞ্চলিক কমিটি কর্তৃক ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে 'ঝুঁকিপূর্ণ ভবন' চিহ্নিত করে ব্যানার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
"বিষয়টি আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটিকে অবহিত করেছি। বর্তমানে পুলিশ ও অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত কার্যক্রম ও আলামত সংগ্রহ চলছে। আলামত সংগ্রহ ও তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলে ভবনটি নিয়ে করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বাধীন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত ডিএসসিসির টেকনিক্যাল কমিটি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।”
ক্ষতিগ্রস্ত পাশের সুরাইয়া ভবন
রোববারের বিস্ফোরণে শিরিন ভবনের পূর্বপাশের সুরাইয়া ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের তৃতীয় তলার এক ফ্ল্যাটের দেয়াল ধসে পড়ে দুই বাসিন্দা আহত হয়েছেন বলে জানালেন আবুল হাসেম লিটন নামের একজন, যিনি নিজে সুরাইয়া ভবনের ১৩ তলায় থাকেন।
লিটন বলেন, ১৬ তলা সুরাইয়া ভবনের অধিকাংশের ফ্ল্যাটে এখন গ্যাস নেই। কারণ শিরিন ভবনের বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে যেখানে পড়েছে, সেখানেই সুরাইয়া ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের গ্যাসের রাইজারগুলো ছিল। তাতে অনেক রাইজার ভেঙে যায়।
তদন্ত কমিটি করেনি ফায়ার সার্ভিস
শিরিন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান মোল্লা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় ধরনের আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যেহেতু এখানে শুধু বিস্ফোরণ হয়েছে, আগুনে ঘটনা খুবই সামান্য। তাই তদন্ত কমিটি গঠন না করার সম্ভবনাই বেশি।”
বিস্ফোরকের আলমত মেলেনি
শিরিন ভবনে বিস্ফোরণের পর সেখানে তল্লাশি চালিয়ে বিস্ফোরকের কোনো আলামত পায়নি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল।
রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির কমাডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "আমরা মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্য। আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি, এ বিস্ফোরণের ঘটনা কোনো বিস্ফোরকের মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি। যদি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা হত, তাহলে যন্ত্রের মাধ্যমে বুঝতে পারতাম।"
তিনি বলেন, “যেহেতু আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক ব্যবহারের কোনো আলামত পাইনি, সেহেতু আরও তদন্ত শেষে পরবর্তীতে জানা যাবে বিস্ফোরণটি আসলে কেন ঘটেছে।”
বিস্ফোরণটি তাহলে কেন হয়েছে জানতে চাইলে মেজর বারী বলেন, “যে কোনো কারণে হতে পারে। তবে প্রকৃত কারণ জানার জন্য আমাদের আরও তদন্ত করতে হবে। আমরা যেহতু বিস্ফোরক শনাক্ত করি যন্ত্র দিয়ে, তাই প্রাথমিকভাবে আমরা বলতে পারি এখানে বারুদ বা আইইডি ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণের আসল কারণ আরও তদন্ত করলে জানা যাবে।”
পুলিশ যা বলছে
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক রোববার সাংবাদিকের বলেছিলেন, প্রাথমিকভাবে এটা দুর্ঘটনা বলেই মনে হয়েছে তার। ঘটনাস্থলে স্প্লিন্টার বা বিস্ফোরক জাতীয় কিছুর আলামত পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, “নানা কারণে বিস্ফোরণের ঘটতে পারে। যেমন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাস জমে থেকে আবার এসির কারণেও হতে পারে।”
তবে নিউ মার্কেট জোনের পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শাহেন শাহ প্রাথমিকভাবে বলেছিলেন, শিরিন ভবনের তৃতীয় তলায় এসি বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তারা মনে করছেন।
রোববার সকাল ১০টা ৫২ মিনিটেরে দিকে ভবনটির তৃতীয় তলায় ওই বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড আশপাশের ভবন কাঁপছিল বলে জানান পাশের ভবনের বাসিন্দা লিটন।
পাশের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের নিউম্যানস টেইলার্সের দোকানদার মাহবুব বলেন, “আমি সবেমাত্র দোতলার দোকানে গিয়ে বসেছি। হঠাৎ বিস্ফোরণে পুরো ভবন কেঁপে উঠল। ভূমিকম্প ভেবে আমি দৌঁড়ে নিচে নেমে আসি।”
রোববার বিস্ফোরণ পর পাশে প্রিয়াঙ্গণ শপিং সেন্টারসহ আশপাশের দোকান বন্ধ ছিল। সন্ধ্যার দিকে কিছু দোকান খুললেও প্রিয়াঙ্গণ বন্ধ ছিল। তবে সোমবার আশপাশের মার্কেট খুলতে শুরু করেছে।
বিস্ফোরণের ঘটনা সাধারণ ডায়েরি করে তদন্ত
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ একটি জিডি করে তদন্ত করছে।
শুধু জিডি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিস্ফোরণের ঘটনা কী কারণে তা তদন্তে বের হয়ে এলে পর সে অনুযায়ী মামলার ধারা হবে। আগে তো ধারা দেওয়া যাচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নিহতের পরিবার মামলা করলে, সেটা নিয়ে আমরা তদন্ত করব।”