সিলেট অঞ্চলের পিছিয়ে পড়ার পিছনে বড় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিতে উঠে আসছে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি।
Published : 03 Aug 2023, 01:01 AM
এসএসসির ফলে দেশের মোট নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে এবারও পিছিয়ে থাকল সিলেট। চিত্রটি নতুন নয় মোটেও। গত ছয় বছরের ফলাফলের উপর চোখ বোলালে দেখা যায়, সিলেট শিক্ষা বোর্ড পাঁচবারই ছিল তলানিতে।
মাধ্যমিকে এই বোর্ডটির ফলাফল এবারও অন্যগুলোর তুলনায় কেন খারাপ হল? স্থানীয় শিক্ষকরা বন্যাকে কারণ দেখালেন। সেই সঙ্গে বলছেন, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার ফল ভালো হলেও মানবিকের খারাপ ফল টেনে নামাচ্ছে সার্বিক হার।
ইংরেজি ও গণিতে যথেষ্ট ভালো শিক্ষক না থাকাকে কারণ দেখাচ্ছেন সিলেট বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সেই কারণে এই দুটি বিষয়ে দুর্বল থেকে যাচ্ছে মানবিকের শিক্ষার্থীরা।
সিলেট অঞ্চলের পিছিয়ে পড়ার পিছনে বড় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিতে উঠে আসছে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। পিছিয়ে পড়া এলাকায় ভালো শিক্ষক যাচ্ছেন না, শিক্ষা অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয় এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতার অভাবের কথা বলছেন তারা।
সিলেট কেন পিছিয়ে থাকছে, তাতে গুরুত্ব দিয়ে সংকট নিরসনে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ফলাফলে যেখানে সিলেট
এবার এসএসসিতে নয়টি সাধারণ বোর্ডে গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সিলেটে এই হার ৭৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। পাসের হার সবচেয়ে বেশি বরিশালে ৯০ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সিলেট বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ২৩ হাজার ১৩৫ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ৭ হাজার ১০৪ জন এবং মানবিক বিভাগ থেকে ৭৯ হাজার ২৯৩ জন শিক্ষার্থী এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।
এদের মধ্যে বিজ্ঞানে ৯১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষায় ৮৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং মানবিকে ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে সিলেট। ঢাকা বোর্ডে যেখানে ৪৬ হাজার ৩০৩ জন শিক্ষার্থী পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে, সেখানে সিলেটে সংখ্যাটি ৫ হাজার ৪৫২।
আগের বছরও ছিল একই অবস্থা। তবে ২০২১ সালের ফলাফলে সিলেট বোর্ডের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, সে বছর কোভিড মহামারীর কারণে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। গণিত, ইংরেজির মতো বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি।
শিক্ষকদের চোখে সংকটের কারণ
সিলেটের কানাইঘাটের ৩ নম্বর দিঘীরপাড় ইউনিয়নের ‘সড়কের বাজার উচ্চ বিদ্যালয়’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমানের মতে, শিক্ষক সংকটই বেশি ভোগাচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
তার স্কুলে প্রধান শিক্ষক অবসরে গেছেন। তিনজন শিক্ষক অন্যত্র চলে গেছেন এবং একজন শিক্ষক মারা গেছেন।
মতিউর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ জন শিক্ষকের সংকট রয়েছে আমার স্কুলে। শিক্ষকদের উপর অনেক চাপ। শিক্ষকরা ক্লাস নিলেও অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের যত্ন না নিলে পড়াশুনাটা তেমন হয় না।”
এই শিক্ষক মনে করেন, এ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকায় অভিভাবকরাও সচেতন নন, সে কারণে তারা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহী নন।
“এখানে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি, বিদেশে যেতে অনেক ছেলেমেয়েই পড়াশুনা ছেড়ে দিচ্ছে।”
আবার কিছু এলাকার দারিদ্র্যকে কারণ দেখিয়ে এই শিক্ষক বলেন, “এখন আমন ধান রোপন হবে। তারা ক্লাস না করে বাবা-মার সাথে জমিতে কাজ করছে। আর্থিক অনটনের কারণেও ক্লাস করছে না। এসব আর্থ-সামাজিক কারণে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে।”
হবিগঞ্জের রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পিন্টু চন্দ্র শীল মনে করেন, পড়াশুনায় ধারাবাহিকতা না থাকা শিক্ষার্থীরা সহজ হিসেবে মানবিকে ঝুঁকছে। আর তার প্রভাব পড়ছে ফলাফলে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বিজ্ঞান বিভাগে সর্বোচ্চ ২৫ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ২৫ জন ভর্তি হলে মানবিকে ভর্তি হয় ১০০ জন। এত শিক্ষার্থী একসাথে ক্লাস করলে এমনিতেই সমস্যা হয়। আর তারা ধরেই নেয় যে, মানবিকে পড়ার দরকার হয় না। ক্লাস না করলেও চলবে। তারা ক্লাসেও উপস্থিত থাকে কম।”
এই শিক্ষক বলেন, “যারা এ বছর পরীক্ষা দিয়েছে, তারা নবম শ্রেণিতে প্রথম ছয় মাস ক্লাস পায়নি। এটাও তাদের খারাপ করার কারণ হতে পারে।”
দীর্ঘদিন স্কুলে গণিত ও ইংরেজির শিক্ষকের সংকটের কথাও বলেন তিনি।
রিচি বিদ্যালয়ে এবার এসএসসিতে বিজ্ঞানে ২ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ১ জন এবং মানবিকে ২০ জন ফেল করেছে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার দাসের বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭৯ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ জন শিক্ষার্থীই পাস করলেও মানবিকে কয়েকজন ফেল করায় প্রতিষ্ঠানটি ফলাফলে পিছিয়ে পড়েছে।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যারা গণিত ও ইংরেজিকে কঠিন মনে করে, তারা মানবিকে পড়ছে। আর এ বছর গণিতের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে।
শিক্ষক সংকটের কথা এল তার মুখ থেকেও।
“অনার্স-মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের আমরা খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিই। কারণ আমাদের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসেরই দুটি করে শাখা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটা ক্লাসের শিক্ষক পেয়েছি, দুইটাতে পাইনি “
অবকাঠামোগত সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার স্কুলে তিনতলার ভিত্তিপ্রস্তর দেওয়া হলেও এক তলা নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ক্লাসরুমেরও সংকট। টিন শেডের একটি ঘর করে নিয়েছি আমরা। কিন্তু গরম পড়লে টিন অনেক গরম হয়ে যায়, তখন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক কমে যায়।”
যা বলছেন বোর্ড কর্মকর্তারা
সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ চন্দ্র পাল এই বোর্ডে ধারাবাহিক খারাপ ফলের জন্য ভৌগলিক অবস্থানকে কারণ দেখাচ্ছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের হাওর এলাকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দূরে দূরে থাকায় শিক্ষার্থীরা অনিয়মিত থাকছে। ওই সব এলাকায় মেধাসম্পন্ন শিক্ষকরাও থাকতে চান না।
“আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় অংশজুড়ে রয়েছে বেসরকারি বা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এগুলোতে গণিত ও ইংরেজিতে তেমন মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নেই। অনেক স্কুলে গণিতের, ইংরেজির শিক্ষকই নাই। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের সংকট প্রকট। মেধাসম্পন্ন শিক্ষকরা শহরে থাকতে চান।”
সিলেট বোর্ডের সচিব অধ্যাপক কবির আহমদ বলছেন, এ বছর পূর্ণ নম্বরে সব বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় গণিত ও ইংরেজিতে পাসের হার অন্য বিষয়ের চেয়ে কম। এছাড়া বন্যার কারণে গত বছর এই বোর্ডের ফল খারাপ হয়েছিল, এর প্রভাব এবছরও রয়ে গেছে।
মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক দেখিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ পাল বলেন, “অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা মনে করে, বিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষা নিলে প্রাইভেট পড়তে হবে। আর্থিক অনটনের মধ্যে সেটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সে নিজে নিজে পড়ে যা হয়, হল। সে কারণেই মানবিকে পড়ে থাকে।”
শিক্ষক সংকট দূর করা জরুরি মন্তব্য করে অধ্যাপক কবির বলেন, ”শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা চলছে, পর্যায়ক্রমে চলতে থাকলে আমি আশা করছি, সিলেট বোর্ড ভালো করবে।”
বিশেষজ্ঞরা যা ভাবছেন
মাধ্যমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনও আছে, বাণিজ্যের শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন। সেটা কেন হবে? শিক্ষক সংকটটা দূর করা খুবই দরকার।”
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে অন্যান্য বোর্ডের মতো সিলেট বোর্ডেও গ্রুপভিত্তিক বিভাজন কমে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
সিলেটের কথা মাথায় রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মনে করেন, কোন অঞ্চলকে পিছিয়ে রেখে দেশে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেট বোর্ড ক্রমাগত খারাপ করছে। এর কারণ আমার মনে হয়, হাওর ও চা বাগান এলাকা, দরিদ্র। সেখানে সরকার চেষ্টা করছে কিন্তু দৃশ্যমান ফল আসছে না।
“সেখানে ভালো শিক্ষক যেতে চায় না। যেহেতু খুবই দরিদ্র এলাকা, তাই মনিটরিংও হয় না। যাদের এই দায়িত্ব তারা করে না, কাজটা তাদের জন্য কঠিন বলে।”
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পরামর্শ, সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি বাড়াতে হবে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে ধরে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি মনে করি, কোনো এক বছরের রেজাল্ট কোনো বছরের মেধার অবনতি বা উন্নতির প্রকাশ ঘটায় না। এই সিস্টেম দীর্ঘদিন ধরেই চলতে থাকে।
“কোন অঞ্চলে কেন পড়াশুনাটা কম? আমি জানি, সিলেটে হাওর অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পড়াশুনাটা কম। সেখানে শিক্ষার মান কম। সেখানে ফোকাস করে সরকারের উচিৎ পড়াশুনার মান বাড়ানো।”
পরিসংখ্যানে জোর না দিয়ে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার যে বিভাজন আছে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ রেখে তিনি মনজুরুল বলেন, “শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াচ্ছেন কি না, যে বিষয়গুলো তারা পড়াচ্ছেন, তাতে তাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না, এই বিষয়গুলোও দেখা উচিৎ।”
গণিত-ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকার পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতারও দায় রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক।
“অনেক স্কুলে গণিতের শিক্ষকরা ক্লাসে সেরাটা দেন না, কারণ তারা সেটা প্রাইভেট পড়ানোর জন্য রেখে দেন। আবার অনেক স্কুলের গণিতের শিক্ষকরা তেমন বোঝেন না। ফলে তার পক্ষে শিক্ষার্থীদের সেভাবে শেখানোও সম্ভব না।”
ভালো মানের শিক্ষক পেতে প্রশিক্ষণ দেয়া, বেতন-ভাতা বাড়াতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পক্ষেও মত দেন তিনি।