সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফিকেও রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
Published : 05 Sep 2024, 12:09 AM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দুই জন নিহতের ঘটনায় দুই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফিকেও আরেক মামলায় রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশের করা রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার তিনজন মহানগর হাকিম বুধবার এই আদেশ দেন।
এর মধ্যে শহীদুল হককে ঢাকার নিউ মার্কেট থানা এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ৮ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে মোহম্মদপুরের দোকানদার আবু সায়েদ হত্যা মামলায়।
আর ইঞ্জিনিয়ার আরিফ মাইনুদ্দিনকে অপহরণ, নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে হাজারীবাগ থানার মামলায় আব্দুল্লাহ হিল কাফিকে ৮ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
শহীদুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
শহীদুল হককে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিউ মার্কেট থানার উপ-পরিদর্শক মো. মোরাদ খান।
রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী শোরশেদ হোসেন শাহীন।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম আকতারুজ্জামান জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে শহীদুল হকের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, গত ৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে, সাবেক আইজিপি শহিদুল হকসহ অন্যান্য আসামিরা আন্দোলন দমনে ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই বিকাল ৫টায় নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে পাকা রাস্তার উপরে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে শত শত সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি বর্ষণ করা হয়। তাতে বহু নিরস্ত্র মানুষ আহত হয়।
ওই সময় প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার পথে মাথার গুলিবিদ্ধ হন আব্দুল ওয়াদুদ (৪৫)।
তদন্ত কর্মকর্তা মোরাদ খান বলেন, মামলার মূল রহস্য উদঘাটন এবং অন্যান্য জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের জন্য শহিদুল হককে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।
শুনানির সময় সাবেক এই আইজিপি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার দাবি করেন।
শহীদুল হক বলেন, "আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি পুলিশকে জনগণের পুলিশ হিসাবে গড়ে তুলেছি। হত্যা তো দূরের কথা, এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি ন্যায়বিচার চাই।"
আব্দুল্লাহ আল মামুন ৮ দিনের রিমান্ডে
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইজিপির পদ হারানো আব্দুল্লাহ আল মামুনকে মঙ্গলবার রাতে সেনা হেফাজত থেকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তাকে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মোক্তারুজ্জামান।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুর থানাধীন বসিলা ৪০ ফিট চৌরাস্তা এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। মুদি দোকানদার আবু সায়েদ সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
বাদীর দাবি অনুযায়ী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনাকে ১ নম্বর আসামি এবং আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়।
মোক্তারুজ্জামান আদালতকে বলেন, আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মামলার মূল রহস্য উদঘাটন এবং সহিংস ঘটনার পেছনে যারা জড়িত তাদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
“বিশেষ করে, হত্যার হুকুম দানকারী ও উস্কানিদাতাদের শনাক্ত করা জরুরি। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এবং প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনতে আসামির রিমান্ডের প্রয়োজন রয়েছে।”
আব্দুল্লাহ আল মামুনের পক্ষে রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন আবেদন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ আব্বাস উদ্দিন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ’ এবং তাকে ‘হয়রানির উদ্দেশ্যে’ মামলায় জড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “আসামি মামলার ঘটনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কোনো লিখিত বা মৌখিক আদেশ প্রদান করেননি। এছাড়া ঘটনাটি শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে ঘটেছে, যেদিন তিনি সরকারি ছুটির দিন উপলক্ষে তার নিজ বাসভবনে অবস্থান করছিলেন।”
আসামির আইনজীবীরা বলেন, সাবেক আইজিপি মামুন বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং লিভার সিরোসিস উল্লেখযোগ্য। তার রক্তনালীতে ৮০% ব্লক থাকায় তিনটি রিং বসানো হয়েছে এবং তাকে প্রতিদিন ১৯টি ওষুধ সেবন করতে হয়। এ কারণে তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন হানগর হাকিম আকতারুজ্জামান।
আব্দুল্লাহ হিল কাফি ৮ দিনের রিমান্ডে
সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফিকে সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মো. আবুল কালাম আজাদ।
১০ বছর বয়সী ছেলে আলিফসহ ইঞ্জিনিয়ার আরিফ মাইনুদ্দিন অপহরণ, নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে হাজারীবাগ থানার এ মামলায় আব্দুল্লাহ হিল কাফি এজাহারনামী ৪ নম্বর আসামি।
তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে বলেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে এবং অন্যান্য পলাতক আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য আব্দুল্লাহ হিল কাফির ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড প্রয়োজন।
তিনি বলেন, “রিমান্ডে আনা হলে মামলার মূল রহস্য উদঘাটনসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।”
আব্দুল্লাহ হিল কাফির পক্ষে রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী সাবিকুন নাহার সুমা।
তিনি বলেন, মামলায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’।
“অভিযোগ করা হয়েছে, আসামিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের কোনো সুনির্দিষ্ট উপাদান নেই। রাজনৈতিক হিংসার কারণে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এই মিথ্যা মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।”
মামলার আরজিতে বলা হয়, মামলার বাদী ইঞ্জিনিয়ার আরিফ মাইনুদ্দিন ২০১৯ সালে তার ভাইরার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা নিয়ে প্রতিবাদ করার পর থেকে তাকে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হয়।
আরিফ মাইনুদ্দিন দাবি করেন, আসামিরা তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে একটি সাজানো মামলার বাদী হতে বাধ্য করেন এবং পরে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি এলাকা থেকে আরিফ মাইনুদ্দিনকে তার ১০ বছর বয়সী ছেলে আলিফসহ অপহরণ করা হয়। তাদেরকে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরে মুক্তিপণ আদায়ের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বাদী অভিযোগ করেন, আসামিরা তাকে মিথ্যা মামলার বাদী করতে বাধ্য করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ‘মিথ্যা হলফনামা ও দলিল’ তৈরি করিয়ে স্বাক্ষর করিয়েছে। আসামিরা তাকে সামাজিকভাবে ‘হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য’ এসব মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।