কক্সবাজার জেলায় ১২ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সোয়া ৩ লাখ।
Published : 15 May 2023, 01:40 AM
সিডরের মতোই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল মোখা, তাই মানুষের মনে জেগেছিল শঙ্কা। তবে উপকূলে আঘাত হানার আগে ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি কিছুটা কমে আসে, আর এর মূল ঝাপটাটি মিয়ানমারের উপর দিয়ে যাওয়ায় বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছে বাংলাদেশ।
রোববার আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই বেশি ক্ষয়ক্ষতির খবর এসেছে। ১২ হাজারের মতো ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হিসাব প্রশাসনের কাছ থেকে মিললেও কারও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
বিশাল আকারের ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে উঠে আসার পর গতি-প্রকৃতি দেখে অনেকটা হাঁফ ছাড়ার সুর ছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের কণ্ঠে।
তিনি দুপুরেই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা পাঁচ বছরে যত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি, তার মধ্যে এবারের আয়োজন…ব্যবস্থাপনাটি ছিল সর্বোচ্চ সঠিক। এবার আমাদের ব্যবস্থাপনা খুবই সুন্দর হয়েছে। কোথাও কোনো লুপহোল ছিল না।”
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঝড়টির তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়া এবং কেন্দ্র বাংলাদেশের উপর দিয়ে না যাওয়ার পাশাপাশি সাগরে ভাটার সময় আঘাত হানায় জলোচ্ছ্বাসও তেমন হয়নি।
তবে অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে মিয়ানারের রাখাইন প্রদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া না গেলেও সেখানে অনেক হতাহত ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা পরিণত স্থল নিম্নচাপে, সংকেত কমল
বিপন্ন রাখাইনে বড় দাগ রেখে গেল ঘূর্ণিঝড় মোখা
টানা তাপপ্রবাহে গরমে অতিষ্ঠ থাকার মধ্যে সাগরে এই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। ঝড়ের বিপদ কাটার সঙ্গে দেশের বড় এলাকায় বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে অতিবর্ষণে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্যঞ্চলে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকছে বলে সতর্কবার্তা রয়েছে।
ঝড়ে মহেশখালীর এনএনজি টার্মিনাল গভীর সাগরে সরিয়ে নিতে হওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট দেখা দিয়েছে গোটা দেশেই। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন লেগে যাবে।
সামুদ্রিক ঝড়টি স্থলভাগে উঠে আসার পর বিপদ সংকেত নেমে গেছে। দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে এখন স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর আবার সচল হয়েছে। বন্দর নগরীর সঙ্গে বিমান চলাচলও শুরু হচ্ছে সোমবার সকাল থেকে। সোমবার থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথেও লঞ্চ ও নৌযান চলাচল শুরু হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলে যে লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছিলেন, বিকালের মধ্যে তারা ঘরে ফিরে গেছেন।
ক্ষতির চিত্র
বিকালের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে সম্পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে ১২ সহস্রাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোফার আঘাতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সোয়া ৩ লাখ মানুষ।
সন্ধ্যায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ সাংবাদিকদের বলেন, জেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪৬৯টি বাড়ি আংশিক এবং ২০২২টি ঝুপড়ি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।
উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েক হাজার ঘর ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ, শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, সেন্ট মার্টিনে ১২০০ মতো ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে।”
জেলাজুড়ে হতাহতের কোনো খবর নেই বলে জানান জেলা প্রশাসক। তবে সেন্ট মার্টিনে গা্ছ চাপা পড়ে একজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুল ইসলাম সন্ধ্যায় বলেন, “প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।”
প্রবাল দ্বীপটির মূল ভূখণ্ডের কোথাও জলোচ্ছ্বাস হয়নি বলেও জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দুর্যোগ সাড়াদান ও সমন্বয় কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, রামু, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলার দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ জন। এসব এলাকার ২০২২টি ঝুপড়ি ঘর সম্পূর্ণ এবং ১০ হাজার ৪৬৯টি ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।
এসব এলাকার ২ লাখ ৩৭ হাজার ২৪১ জন সাময়িকভাবে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন জানিয়ে মন্ত্রণালয় বলছে, সেখানে শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়।
দুপুরে প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সেন্টমার্টিনে ৩৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে সাড়ে ৮ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন। এ ছাড়া কক্সবাজারে ৫৭৬টি কেন্দ্রে ২ লাখের বেশি, চট্টগ্রামে ১ হাজার ২৪ আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ লাখ মানুষ আশ্রয় নেন।
এবারের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাজের প্রশংসাও করেন প্রতিমন্ত্রী।
#CycloneMocha hit Cox’s Bazar ????????. As one of the leading agencies of the #RohinygaResponse, @UNmigration has taken all necessary initiatives to respond to the cyclone, in coordinating with #GoB & other humanitarian actors.
— Abdusattor Esoev (@AbdusattorEsoev) May 14, 2023
????️Watch the video to learn more???? pic.twitter.com/PuEFOUajGD
বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার
ঘূর্ণিঝড় মোফা ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে সেন্ট মার্টিনে আঘাত হেনেছিল বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে সেন্টমার্টিন পার হওয়ার সময় ঝড়ের সর্বোচ্চ ১৪৭ কিলোমিটার গতি রেকর্ড করা হয়।
তিনি বলেন, “অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগের প্রভাব শনিবার ভোররাত ৩টা থেকে শুরু হয়, আর অগ্রভাগ সকাল ৯টা থেকে বাংলাদেশ-মায়নমার উপকূল অতিক্রম শুরু করে। বেলা ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে মূল কেন্দ্র পার হয় এবং সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়ের পুরো শরীর উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে।”
এই ঝড়টির ব্যাস বিশাল হওয়ায় এটির উপকূল অতিক্রম করতে ১৫ ঘণ্টার মতো সময় লাগে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়।
আবহাওয়া অফিসের সর্বশেষ বুলেটিন বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে এলাকার কাছ দিয়ে কক্সবাজার-মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করে রোববার বিকাল ৩টায় মিয়ানমারের স্থলভাগে অবস্থান করছিল। সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে।
রাত ৮ টায় আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানান, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে এবং মংলা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটারে উঠেছিল। তবে ওই ঝড়টি গেছে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের মাঝামাঝি দিয়ে। অর্থাৎ গোটা ঝড়ের ঝাপটাই পড়ে বাংলাদেশের উপর। সেবার সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
মোখা সাগরে থাকা অবস্থায় তার কেন্দ্রে বাতাসের বেগ সেই বেগকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে উপকূলে আঘাত হানার আগে এর গতি কিছুটা কমে আসে। তবে তখনও ঝড়টির শক্তি কম ছিল না।
রোববার সকালে এ ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ যখন উপকূল অতিক্রম শুরু করে।, তখন এর কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৯৫ কিলোমিটার ছিল, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
গত কয়েক বছরে দুটি ঝড় আম্পান ও সিত্রংয়ে প্রাণহানির ঘটনা যেমন ঘটেছিল, তেমনি প্রতিটিতে হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতিও হয়েছিল।
এক সপ্তাহ আগে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। এটি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে রূপ নেয় ঘূর্ণিঝড়ে, নাম পায় মোখা। সেই ঝড়টিই উপকূল অতিক্রমের পর বিলীন হওয়ার পথে।
শনিবার- দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।
সোমবার- মধ্যরাতে একই এলাকায় তা সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়।
মঙ্গলবার- আরও ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে রূপ নেয় এটি।
বুধবার- গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়।
বৃহস্পতিবার- গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
শুক্রবার- প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
শনিবার- চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় এটি, এক পর্যায়ে তা সুপার সাইক্লোনের শক্তিও পায়।
রোববার- শক্তি কমে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এর উপকূল অতিক্রম।
আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের দেওয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হয়। এসকাপের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এটি ইয়েমেনের দেওয়া ‘মোখা’ নাম পায়।
ভারি বর্ষণ আগামী ৩ দিন
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে তাপমাত্রা কমেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রোববার রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত কয়েকদিনের চেয়ে বেশ কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগ অতিক্রমের পর সোমবার থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে তিন বিভাগে। সোমবার ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বাড়বে।”
সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা এক থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে।