মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব।
Published : 08 Apr 2025, 09:19 PM
গৃহযুদ্ধের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিচ্ছে তার পথ হিসেবে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।
এক্ষেত্রে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনায় জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করার কথাও বলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফেরার গুরুত্ব তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, “আরাকানে যাতে শান্তি এবং স্থিতি দ্রুত ফিরে আসে…সেখানটাই অত্যন্ত কঠিন.. একটা মানবিক পরিস্থিতি যাচ্ছে। সেটা নিরসনের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে, বিভিন্ন দেশের সাথে কাজ করছি।
“এবং আমরা যত দ্রুত সম্ভব চেষ্টা করছি, সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিরসন করতে পারি। সেজন্য দরকার হচ্ছে বিবদমান দুপক্ষের যুদ্ধের বিরতি। আমি আপনাদের বলতে পারি, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে, মানবিক সহায়তা জাতিসংঘ যখন দেবে, যেটাতে আমরা সাহায্য করব, সেটাতে দুপক্ষই যুদ্ধাবস্থা পরিহার করবে।”
এর মাধ্যমে একটা স্থিতির সূচনা হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং খুব বেশি দেরি নেই সেটা, এবং সেই সময় থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একটা বাস্তব আলোচনা আমরা শুরু করতে পারব।”
রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতিতে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হিসাবে অভিহিত করে খলিলুর রহমান বলেন, “এই জায়গা থেকে আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি থাকবে না। আমরা চেষ্টা করব, যাতে মানবিক সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়াতে আরাকানে একটা স্থিতির অবস্থা আসে, শান্তির অবস্থা আসে এবং সেখান থেকে আরাকান তার নবসূচনা করতে পারে।
“সেটাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে একটা বড় প্রয়োজনীয় বিষয়। তাদেরকে (রোহিঙ্গা শরণার্থী) আমরা একটা অনিরাপদ অবস্থায় ফেলে দিতে পারি না।”
৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রথম আসার কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন তিনি।
“তাকে আমরা বলেছি, রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা, যে সংকট সেটা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নাই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে।”
মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ, রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়।”
মানবিক চ্যানেল তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে জাতিসংঘই আলোচনায় বসাচ্ছে তথ্য দিয়ে হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় জাতিসংঘকে মাঝামাঝি রাখা হয়েছে।
“এ কারণে যে, আমরা আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনে আবদ্ধ একটি রাষ্ট্র। আরাকান আর্মি বা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান, তারা নন-স্টেট অ্যাক্টর, এ ধরনের কোনো চুক্তি বা আন্তর্জাতিক নর্মস তাদের জন্য বাধ্যবাধকতা নেই, কারণ তারা এর পক্ষ নয়। এজন্য তারা যাতে জবাবদিহির মধ্যে থাকে, এই আলোচনাটা যাতে চলে, সেজন্য আমরা জাতিসংঘকে মাঝামাঝিতে রেখেছি।
“তারা (জাতিসংঘ) আমাদের দুপক্ষকে এক টেবিলে বসাচ্ছে। আমাদের মনে হয়, এটা সর্বোত্তম উপায় এই কারণে, আরাকানে যে মানবিক সাহায্যের কথা আমরা ভাবছি, এটা কিন্তু জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন একটি প্রক্রিয়া, জাতিসংঘ নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং তাদের মাধ্যমে কথাবার্তাটা বলাই উত্তম। কারণ, তারা একটা নিরপেক্ষ পক্ষ।”
প্রত্যাবাসনের কী অগ্রগতি
দীর্ঘদিন পর ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করে বাকীদের ভেরিফিকেশন এগিয়ে নেওয়ার যে বার্তা মিয়ানমার সরকার দিয়েছে, সেটাকে বড় অগ্রগতি হিসাবে উল্লেখ করলেও প্রত্যাবাসনে সময় লাগার কথা বলেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
রোহিঙ্গারা যে সহসাই ফিরে যাচ্ছে না, সে তথ্য দিয়ে হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর বলেন, “যাদেরকে ক্লিয়ার করা হয়েছে, তারাতো কালকেই চলে যাচ্ছে না। যে কোনো প্রত্যাবাসনের একটা প্রক্রিয়া লাগে।
“তারা যাবেন, কী করে যাবেন, সে জায়গাতে কী অবস্থা আছে, নিরাপত্তা আর সুরক্ষা আছে কি না এবং ওখানে যে তারা যাবেন, তাদের জীবনজীবিকার সংস্থান আছে কি না। শুধু রোহিঙ্গার ব্যাপারে নয়, যে কোনো প্রত্যাবাসনে এ ধরনের বিষয়গুলো আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এবং এগুলো নিরসন করতে হবে।”
সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাখাইন মিয়ানমারের সার্বভৌম ভূখণ্ড। সেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে আরাকান আর্মির নীতিগত অবস্থান থাকার কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, “তারা এটা প্রকাশ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বলেছে। আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় তারা এটা পুনর্ব্যক্ত করেছেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে।
“সে কারণে আমরা মনে করি, এই যে ১ লাখ ৮০ হাজার, তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত আমরা করতে পারব। সময় লাগবে। যাতে তারা দ্রুততম সময়ে যেতে পারে, আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে সেটাই।
“আমরা মিয়ানমার সরকার, আরাকানে যারা বাস্তবে কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং আমাদের যে বন্ধু দেশ আছে, সবার সঙ্গে মিলে এই কাজটি করব। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামীবারের ঈদ তারা দেশে গিয়ে করবেন, সেটাই হল আমাদের লক্ষ্য।”
গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ‘যথেষ্ট অগ্রগতি’ হওয়ার কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে, এই বিষয়টা মানুষ ভুলেই যাচ্ছিল। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এটাকে জাতিসংঘে তুলেছেন, তাদের আয়োজনে একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন।
“জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউএনএইচসিআর প্রধান বাংলাদেশে এসে বলেছেন, প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। প্রত্যাবাসন একটা ইস্যু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আর কোনো ইস্যু নাই এবং প্রত্যাবাসনের বিষয়ে প্রথমবারের মত একটা সংখ্যা পেলাম। গত আট বছরে এই সংখ্যাটা আমাদের কাছে ছিল না। এই প্রথম মতৈক্যের ভিত্তিতে একটা সংখ্যা আমরা পেলাম।”
প্রত্যাবাসনের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত হওয়াকে ‘নতুন ডাইমেনশন’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, “অনেক কাজই গত আট বছর করি নাই। অনেক কিছু একসঙ্গে করতে হবে। আপনি একটা একটা করে বেছে বেছে করতে পারবেন না। পুরো জিনিসটা একসঙ্গে দেখতে হবে।
“জিনিসটা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আরাকানের সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা শান্তিময় পরিবেশ না হলে আপনি যুদ্ধের ভেতরে কাউকে ঠেলে দিতে পারেন না।”
প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর বলেন, “আমরা সবসময় বলছি, স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন। আমরা কাউকে ঠেলে দিব না। কিন্তু যাওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে আছেন। সেই যাওয়াটা যেন সবাই নিজের ইচ্ছায় যায়।
“সেটা বর্তমান যুদ্ধাবস্থা আছে, স্থিতির অভাব আছে, সেটা নিরসন না করেতো হচ্ছে না। শুধু আমরা করছি না, সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। এই ডাইমেনশনটা আমাদের আগে ছিল না, অনেক ডাইমেনশন আমাদের আগে ছিল না।”