ঢাকার তুরাগে এক নারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ।
Published : 19 Jun 2023, 01:28 AM
ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজন আলাল উদ্দীনের আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে স্বজনদের কাছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হালিমা নামে তার এক স্বজনের আক্ষেপ, “সুস্থ মানুষটা হাইট্টা গেল, আর লাশ আইল ঠ্যাং ভাঙা।”
রোববার বিকাল ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল মর্গ থেকে নিরাপত্তাকর্মী আলাল উদ্দীনের লাশ বুঝে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তার ভাই মামুন দেওয়ান। পরে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানে করে পরিবারের লোকজন নিজেদের এলাকা তুরাগ থানার বাউনিয়ায় যান।
সেখানকার পুকুরপাড়ে লাশবাহী ভ্যানটি রাখা হলে সেখানে শতশত মানুষ ভিড় জমান একনজর দেখতে। আলাল উদ্দীনের জন্য বিলাপ করছিলেন কেউ, আর কেউ দেখান ক্ষোভ।
ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা যাওয়া আলাল তুরাগ থানার বাউনিয়া এলাকার একটি বাসার নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।
ওই বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে গত ৬ জুন ভাড়াটে ফাতেমা আক্তারের (৩৩) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মামলায় ওই নারীর চতুর্থ স্বামীকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানা পুলিশ। এ মামলাতেই সন্দেহভাজন হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ গ্রেপ্তার দেখায় আলালকে।
ঘটনার বর্ণনায় নিহতের স্বজন হালিমা বলছিলেন, ৬ জুন ওই বাসার ভাড়াটে নারীর লাশ উদ্ধারের পর আলাল সারাদিনই বাসায় আসেননি। তারা শুনেছেন তুরাগ থানার পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
“সন্ধ্যার আগ দিয়ে তিনি বাসায় এসে গোসল করেন, খাবেন বলে স্ত্রীকে জানান। এসময় কেউ একজন ফোন করে আলালকে জানান, ডিবির লোকেরা তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এরপর বাসা থেকে হেঁটে ঘটনাস্থলের দিকে যান আলাল।”
যেখানে লাশবাহী ভ্যানটি রাখা হয়, তার পাশেই একটি টিনশেড বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন আলাল। তার নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে জানালা দিয়ে দেখছিল- বাবার লাশের পাশে মানুষের ভিড়, আর তার মা পারভীন বেগম বিছানায় পড়ে আছেন। পারভীনকে ঘিরে রেখেছেন ৮-১০ জন নারী, যারা নিজেদের পরিচয় দিলেন স্বজন ও প্রতিবেশী হিসেবে।
আলালকে কবে, কী অবস্থায় ধরে নেওয়া হয়েছিল পারভীনের কাছে তা জানতে চাইলে তার সঙ্গে থাকা নারীরা জানান, পারভীন কথা বলতে পারবেন না। স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই তিনি বিলাপ করছেন, উল্টো-পাল্টা বলছেন।
আলালের দুই ছেলে-মেয়েই স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়েন। তারা কেউই গ্রেপ্তারের দিন বাবাকে দেখেনি। সেই আফসোসে কাঁদছিল দুই ভাই-বোন।
আলালের ফুফাতো ভাই লিয়াজ উদ্দীন ঢাকা মেডিকেল মর্গে সাংবাদিকদের বলেন, “আলালের স্বাস্থ্য ভালো ছিল, তার কোনো হৃদরোগ ছিল না।”
মৃতের লাশ দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আলালের দুই পা ভাঙা এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের দাগ রয়েছে।”
গ্রেপ্তারের পর ডিবির হেফাজত থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়ে স্বজনদের মধ্যে আলোচনা চললেও এ বিষয়ে একেবারেই নীরব ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আগের দিন থেকেই ডিবির কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন না। তুরাগ থানা পুলিশও আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে না কিছু।
পুলিশের ভাষ্য জানতে দিনের বিভিন্ন সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুককে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ডিবির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনারকেও দিনভর ফোন করে পাওয়া যায়নি।
আলাল উদ্দীনের মৃত্যুকে ঘিরে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, “বিষয়টি জানা নেই”।
তদন্ত চায় আসক
এদিকে আলাল উদ্দীনের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। রোববার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ দাবি করেন।
সংবাদমাধ্যমের বরাতে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ডিবি হেফাজতে নির্যাতনের কারণে আলাল মারাত্মক আহত হন এবং পরে মারা গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা। গত ৬ জুন ঢাকা ডিবি তুলে নেওয়ার পর থেকে আলালের খোঁজ পাচ্ছিলেন না তারা।
ঢাকায় গ্রেপ্তার ব্যক্তির মৃত্যুর পর পুলিশের লুকোছাপা
গ্রেপ্তারের পর থেকে ‘অন্ধকারে’, হাসপাতালে মৃত্যুর পর জানলেন স্বজনরা
“তবে ডিবির ভাষ্য, ১০ জুন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলালকে কবে ধরে আনা হয়েছে, কত দিন হেফাজতে ছিলেন, কেন তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করাতে হল, কোন পরিস্থিতির কারণে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিতে হল- এসব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।”
আসক বলছে, “হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী আলাল উদ্দীনের পরিবার যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, তা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে।”