স্বজনদের অভিযোগ, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতন করা হয়েছে; যা অস্বীকার করে পুলিশ বলছে, ওই ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন, ‘পুলিশ হেফাজতে’ নয়।
Published : 18 Jun 2023, 12:36 AM
ঢাকার তুরাগ থানায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার এক ব্যক্তির 'ভাঙা পা' নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বজনরা; যারা তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর কিছুই জানতে পারেননি।
৫০ বছর বয়সী এ ব্যক্তির মৃত্যুর পর হাসপাতালে পুলিশ তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাতেও সময় লেগেছে বেশি। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা এ ব্যক্তির গ্রেপ্তার ও মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্য বা বক্তব্যও দিচ্ছেন না।
স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ সুস্থ অবস্থায় তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতন করা হয়েছে; যে কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, ওই ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন, ‘পুলিশ হেফাজতে’ নয়।
ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার কিছু সময় পর মারা যাওয়া মো. আলাল উদ্দীন তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া এলাকার একটি বাসার নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।
ওই বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে গত ৬ জুন ভাড়াটে ফাতেমা আক্তারের (৩৩) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মামলায় ওই নারীর চতুর্থ স্বামীকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানা পুলিশ। এ মামলাতেই সন্দেহভাজন হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ গ্রেপ্তার দেখায় আলালকে।
আলাল উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার ফারুক হোসেন জানান, ওই ব্যক্তি ডিবির মামলার আসামি। ডিবি যখন তাকে ধরে তখনই তার 'পা ভাঙা' ছিল। পরে আদালতের আদেশের ভিত্তিতে তাকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
তার ভাষ্য, পঙ্গু হাসপাতালে ৫-৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার এক পর্যায়ে তার রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যায়। তখন পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে রেফার্ড করে। হৃদরোগ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতে তার মৃত্যু হয়।
উপ কমিশনার ফারুক বলেন, “তিনি যে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন এ বিষয়ে চিকিৎসকেরা প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। পুলিশের হেফাজতে সে কখনও ছিল না।“
আলালের ভাইদের দাবি ৬ জুন হত্যাকাণ্ডের পরপরই পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যায়। পুলিশ হেফাজতে না থাকলে তিনি কোথায় ছিলেন- এমন প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক বলেন, “হ্যাঁ, আটক করার সময়ই তার পা ভাঙা ছিল। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠায় পুলিশ।”
শুক্রবার সন্ধ্যার পর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে আলালের মৃত্যু হলেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের পাশের একটি কক্ষে রাখা ছিল লাশটি, যা নিয়ে তৎপর ছিল পুলিশ। সেসময় ওই কক্ষের সামনে থাকা পুলিশ সদস্যরা কাউকে সেদিকে যেতে দিচ্ছিলেন না।
শেরেবাংলা নগর থানা এবং তুরাগ থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সেখানে গেলেও তারাও কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ নিয়ে বক্তব্য দিতে চাননি।
এদিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ওই লাশের কোনো সুরতহাল হতেও দেখা যায়নি।
হাসপাতালে আলালউদ্দীনের চাচাতো ভাই জাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, তার ভাই আলালউদ্দীন যে বাসায় নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করতেন সেখানে একটি হত্যাকাণ্ডের পর (৬ জুন) সুস্থ অবস্থায় ডিবির লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে যান। এরপর থেকে তার কোনো খবরই পায়নি পরিবার।
"এখন তাদের পা ভাঙা লাশ দেখাচ্ছে পুলিশ, বলা হচ্ছে পা ভাঙা অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।"
তার অভিযোগ, আলালউদ্দীনকে ডিবি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যার পর মৃত্যু
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে দেওয়া আলালউদ্দীনের মৃত্যুর সনদপত্রে বলা হয়েছে, শুক্রবার (১৬ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাকে ওই হাসপাতালে আনা হয়, সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। তার লাশ বুঝে নেন পুলিশের এসআই ফাহাদ হোসেন। এরপর শনিবার রাত ৮টার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
আলালউদ্দীনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে, ‘কার্ডিও রেসপারেটরি ফেইলিওর’, ‘কার্ডিওজিনিক শক’, ‘সাস্পেক্টেড পালমোনারি এমবোলিজম’।
এছাড়া সনদপত্রে তার ডান পায়ের গোড়ালিতে ‘সফট টিস্যু’ ইনজুরির কথা বলা হয়েছে।
ওই হাসপাতালের দুজন চিকিৎসককে মৃত্যুর সনদপত্রটি দেখিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা বলেন, পায়ে কোনো আঘাতের ফলে গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে- এ অবস্থাকে বলা হচ্ছে ‘পালমোনারি এমবোলিজম’। এই রোগীর (আলালউদ্দীন) ক্ষেত্রে এরকম কিছু হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৃত্যু সনদের ছকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘রোগ, আঘাত, যুদ্ধ ও অন্যান্য’- এ চার কারণ লেখা থাকে। আলালউদ্দীনের মৃত্যু সনদে চিকিৎসক ‘রোগ’ এর ঘরে টিক দিয়েছেন।
সাধারণত কোন ব্যক্তির অস্বাভাবিক অথবা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। তবে আলালউদ্দীনের মৃত্যুর পর তার মরদেহ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে সাত কিলোমিটার দূরের ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাতে সময় লেগেছে পুরো ২৪ ঘণ্টা। রাত আটটার পর লাশ পাঠানো হয়েছে মর্গে।
স্বজনদের অভিযোগ
নিহতের স্বজনরা জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক আলালউদ্দিন বাউনিয়া এলাকায় বহুদিন ধরে একটি বাসায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করে আসছেন। ৬ জুন ওই বাড়ির ভাড়াটে ফাতেমার লাশ উদ্ধারের সময় তুরাগ থানার পুলিশ আলালউদ্দীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়। পরে ডিবির লোকজন এসে তাকে সুস্থ অবস্থায় ধরে নিয়ে যায় বলে দাবি তাদের।
নিহত আলালউদ্দীনের মামাতো ভাই লিয়াজ উদ্দিন জানান, ফাতেমা হত্যার ঘটনায় তাকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি। এরপর তাকে কোথায় নেওয়া হয় তা পরিবারের সদস্যরা জানানো হয়নি। স্বজনেরা মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের ফটকে গেলেও ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাননি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ওই নারীর লাশ উদ্ধারের তিন দিন পর তার স্বামী সাইফুল ইসলাম রানাকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানা পুলিশ। পরদিন তাকে পুলিশ আদালতে চালান করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। অথচ আলালের নামে কোনো মামলা নেই। তারপরও তাকে ধরে নিয়ে পরিবারকে অন্ধকারে রাখা হয়। তার কোনো খোঁজ মেলেনি।
“শেষে শুক্রবার রাতে হাসপাতাল থেকে খবর পাই, তিনি মারা গেছেন।“
ডিবির উত্তরা বিভাগ আলালকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে পরে তাকে হৃদরোগ ইনন্সটিউটে নেওয়া হয়।
নিহতের চাচাতো ভাই জাহিদুল ইসলামের অভিযোগ, “ডিবির মারধরে আলালের মৃত্যু হয়। বাসা এলাকা থেকে তুলে নেওয়ার পর থেকে পুরো সময় তার ব্যাপারে পরিবারকে কিছুই জানায়নি পুলিশ। শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা গেছে বলে তারা শুনেছেন, কিন্তু শনিবার রাত ৮টা বাজে এখনও জানি না তার লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে।“
হৃদরোগ হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর যে সনদপত্র দেওয়া হয়েছে তাতে স্বাক্ষর করে লাশ গ্রহণ করেছেন এসআই ফাহাদ হোসেন।
যদি আলাল পুলিশ হেফাজতে না থাকে তাহলে তার লাশ পুলিশ বুঝে নেয় কী করে জানতে চাইলে পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, “সে তো মামলার আসামি- তাই না, পুলিশ লাশ নিয়ে পোস্টমর্টেম করে তারপরে ফ্যামিলির কাছে হস্তান্তর করবে।
“পুলিশ যদি কাউকে গ্রেপ্তার করে আর সে যদি অসুস্থ থাকে আদালতের আদেশে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশ প্রহরায় তার চিকিৎসা চলতে থাকে। যখন হাসপাতালে এডমিটেড হয়ে যায় তখন তো পুলিশের আর কোন সে (বলার) থাকে না।”