বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেলুন বিক্রেতারা সিলিন্ডারে যে পদ্ধতিতে গ্যাস তৈরি করেন, সেটি ‘বোমা নিয়ে খেলার মতো’।
Published : 28 Sep 2022, 12:59 AM
উৎসব রাঙাতে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও আছে গ্যাস বেলুনের ব্যবহার; আর শিশুদের জন্য বিভিন্ন কার্টুন আকৃতির বেলুনের দেখা হরহামেশাই মেলে পথ-ঘাটে।
কিন্তু আনন্দের অনুসঙ্গ এই গ্যাস বেলুনই হয়ে উঠেছে আতঙ্কের নাম। গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।
সম্প্রতি গাজীপুর পুলিশ লাইনসের এক অনুষ্ঠানে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে দগ্ধ হন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আবু হেনা রনিসহ কয়েক পুলিশ সদস্য।
এই ঘটনায় বেলুন বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডারের নামে যে ‘বোমা’ পথের আনাচে-কানাচে রয়েছে, তা ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
কেন ভয়ঙ্কর?
উন্নত দেশে যেসব বেলুন ওড়ানোর জন্য বানানো হয়, তাতে ‘হিলিয়াম’ গ্যাস ব্যবহার করা হয়। হিলিয়াম থেকে আগুন ধরে না, বিস্ফোরণের সম্ভাবনাও খুব কম। তবে এর দাম অনেক।
এ কারণে বাংলাদেশের বিক্রেতারা বেশি লাভের আশায় হিলিয়ামের পরিবর্তে ব্যবহার করেন দাহ্য হাইড্রোজেন গ্যাস।
তারা নিজেরাই সিলিন্ডারের ভেতর রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে এই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন। অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই গ্যাস তৈরির প্রক্রিয়াটিকেই ভয়ঙ্কর বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
রসায়নবিদ সুনন্দা রানী বর্মন বলছেন, হাইড্রোজেন অতি দাহ্য। এ কারণে রসায়নবিদদের প্রটোকলে খুব নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে একে নাড়াচাড়ার কথা বলা হয়েছে।
“বেলুন বিক্রেতারা যে পদ্ধতিতে এটা করেন, সেটা একটি বোমা নিয়ে খেলার মতো।”রসায়নবিদ সুনন্দা রানী বর্মন
বেলুন বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে উড়ন্ত বেলুন তৈরির অনেকগুলো পন্থা রয়েছে। তবে এদেশের বেশিরভাগ বিক্রেতা কাস্টিং অথবা কস্টিক সোডা ব্যবহার করেন।
কাস্টিং হল পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা কস্টিক পটাশ। এর সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম বা সিলভার মিশিয়ে তৈরি হয় গ্যাস। কোন কোন বেলুন বিক্রেতা কস্টিক সোডাও (সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড) ব্যবহার করেন।
রসায়নবিদরা বলছেন, এই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ তৈরি হয়। রাসায়নিকের মিশ্রণটা পরিমাণ মতো না হলে বিক্রিয়াটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। যার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলো ঘটে।
উৎস কোথায়?
মাছ, পাখি, বল, মিনিয়ন কিবা মোটু-পাতলুর মতো কার্টুন আকারের অসংখ্য বেলুন বিক্রি হয় ঢাকার রাস্তায়। মেলা কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের খবরে সিলিন্ডার নিয়ে ছোটেন বেলুন বিক্রেতারা। জনসমাগমপূর্ণ জায়গাতে বসেই সিলিন্ডার থেকে বেলুন ভরে বিক্রি করেন।
কী আছে ওই সিলিন্ডারে- এমন প্রশ্নে এক শিশু বেলুন বিক্রেতার সূত্র ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় বেলুন প্রস্তুতকারক মো. ইসমাইলের সঙ্গে।
মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার ঘরে বসে বেলুনে গ্যাস ভরেন ইসমাইল। এজন্য তিনি বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটি সিলিন্ডার তৈরি করিয়ে নিয়েছেন।
ইসমাইল বলেন, একেকটি গ্যাস সিলিন্ডার তৈরি করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। সাধারণ ঝালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বা গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার ওয়ার্কশপে কেটে তা নেওয়া হয়।
“সিলিন্ডারের ওপরে চাবিসহ একটি ভাল্ব ও পাশে আরেকটি ফুটো করা হয়। লেদ মেশিনে ওই ফুটোর মাপে শক্ত প্যাঁচওয়ালা নাট বানিয়ে দেন কারিগরেরা। ওই প্যাঁচ খুলে তার ভেতরে পানি ও ‘মেডিসিন’ দেওয়া হয়।”
কাস্টিং আর সিলভারের লগে পানি দেওয়া লাগে। তাতেই গ্যাস হয়।বেলুনে গ্যাস ভরার কারগির ইসমাইল, মেডিসিন কী- জানতে চাইলে বললেন
ভেতরে কী প্রক্রিয়ায় গ্যাস তৈরি হয় সেই বিক্রিয়া সম্পর্কে তাত্ত্বিক কোনো ধারণা নেই ইসমাইলের। তিনি কেবল জানেন, বেশি গরম হয়ে গেলে পানি ঢেলে বা ভাল্ব খুলে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ইসমাইল জানান, বাড়িতে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় বেশিরভাগ বেলুন বিক্রেতা সিলিন্ডারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণত পানিভর্তি ড্রাম কিংবা গর্ত করে তাতে পানি ঢেলে তার মধ্যে সিলিন্ডারটি রাখেন। কেউ বেলুন ভরার সময় সিলিন্ডারে ভেজা কাঁথা পেঁচিয়ে রাখেন। তবুও কখনও কখনও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বেলুন বিক্রেতারা বলছেন, ঢাকার চকবাজার বা মিটফোর্ড রাসায়নিক মার্কেটে অল্প টাকাতেই পাওয়া যায় কস্টিক সোডা কিংবা কস্টিক পটাশের মতো রাসায়নিক। আর চকবাজার থেকে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন আকৃতির বেলুন, যেগুলো চীন থেকে আনা হয়। চকবাজারের পাইকারি বাজারে এরকম এক হাজার চীনা বেলুন বিক্রি হয় পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকায়। পরে সেটিতে গ্যাস ভরে তারা বিক্রি করেন।
বাজারে এক থেকে দেড়শ টাকায় কেজিখানেক কস্টিক পটাশ পাউডার পাওয়া যায়। কস্টিক সোডার দাম আরও কম। অন্যদিকে বেলুনে যে হিলিয়াম গ্যাস ভরার কথা, তার দাম অনেক বেশি।
ভারতের ইকমার্স সাইট ইন্ডিয়া মার্ট ডটকমে দেখা যায়, প্রতি ঘনমিটার হিলিয়াম গ্যাসের দাম দেড় হাজার থেকে ২ হাজার রুপি। গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে বাইপ্রডাক্ট হিসেবে হিলিয়াম তৈরি হয়।
বাজারে এই গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। ফলে হিলিয়াম গ্যাস একটি মাঝারি আকারের বেলুনে ভরতেই শ-খানেক টাকা খরচ হয়ে যায়। অন্যদিকে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরলে বিক্রেতাদের বেলুনপ্রতি তেমন কোনো খরচই হয় না।
ইউটিউবে একটি চ্যানেলে বেলুন বিক্রি ব্যবসা নিয়ে কথা বলছিলেন কুমিল্লার বেলুন বিক্রেতা মজিবর রহমান।
শুক্রবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মজিবর বলেন, তিনি বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন পাখি, মাছ, কার্টুন চরিত্রসহ বিভিন্ন আকারের উড়ন্ত বেলুন পাইকারি বিক্রি করেন। এক হাজার বেলুন ২২ হাজার টাকা।
এসব বেলুন দাহ্য কি না- জানতে চাইলে মজিবর বলেন, “বেলুনের কাছে আগুন আনলে বেলুন ফাটব। কাছাকাছি তাপ বা সিগারেটের আগুনেও আগুন ধরব। আর না হইলে দুই মাস রাখলেও বেলুনের কিছু হইত না।”
ফেইসবুকে হিলিয়াম গ্যাস বেলুনের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করা হলে বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “ভাই এটার নাম হিলিয়াম বেলুন হলেও আমরা কেবল হাইড্রোজেন গ্যাসের বেলুনই বিক্রি করি। বাংলাদেশে কেউ হিলিয়াম বেলুন বিক্রি করে না, কারণ এটা অনেক এক্সপেনসিভ।
“দেশে সিলিন্ডারে কেমিকেল ভরে ম্যানুয়ালি যে বেলুন হয়, সেগুলোই সব অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়।”
দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে
সর্বশেষ গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে গাজীপুর মহানগর পুলিশের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে জেলা পুলিশ লাইনস মাঠে নাগরিক সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন হয়েছিল। সেখানে হঠাৎ গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণ হলে কৌতুক অভিনেতা রনিসহ আহত হন চার পুলিশ কন্সটেবল।
এর আগে ৯ জুলাই পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বড়দিঘী বাজারে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে কিশোর বেলুন বিক্রেতা সোহাগ ইসলামের (১৫) মৃত্যু হয়। এসময় লিমন নামে ১০ বছর বয়সী আরেক শিশু আহত হয়।
এ ছাড়া গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা বাজারে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বেলুন বিক্রেতা ইউনুস আলী নিহত হন, আহত হয় চার শিশু।
চলতি বছরের ১৫ জুন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শংকরদী গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। ওই ঘটনায় বেলুন বিক্রেতা জাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত তিন শিশুর একজন পরে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যায়।
গত ১৩ মে রাজশাহীর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিন জন আহত হন। ব্যাংকার্স ক্লাব রাজশাহীর উদ্যোগে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওড়ানোর জন্য বেলুন ফোলানোর সময় ওই ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কুমিল্লার ঠাণ্ডাকালী মেলা এলাকায় গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে শিশুসহ ৪১ জন আহত হয়।
আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১২ বছর বয়সী শিশু আহসানের মৃত্যু হয়, আহত হন ১৫ জন।
তবে সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার রূপনগরে। সেদিন বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭ শিশু নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হন। ওই ঘটনায় গ্যাস বেলুন নিয়ে আলোচনা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
ব্যবস্থা নেবে কে?
দেশের বিস্ফোরক পরিদপ্তরের জনবল কম থাকায় বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্সিংয়ের কাজ নিয়েই তাদের গলদঘর্ম।
পুলিশ যে বিষয়টি নিয়ে অসচেতন, তা নিজেদের অনুষ্ঠানে গ্যাস বেলুন রাখার ঘটনায়ই স্পষ্ট।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, কোনো ঘটনা ঘটে গেলে তারা ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার’ বা প্রথমে সাড়া দেন। এর বাইরে তারা ঘটনার বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয়, সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু গ্যাস বেলুন যেভাবে পথেঘাটে বিক্রি হয়, এটা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের নেই।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেকোন জিনিস সেফটি-সিকিউরিটি মেনে ব্যবহার না করলে সেটার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বেলুন বিক্রি করছে, এটা ঝুঁকিপূর্ণ।
“গ্যাস সিলিন্ডার, সিলিন্ডার, রাসায়নিক এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের পৃথক দপ্তর আছে। আমরা কিন্তু ফার্স্ট রেসপন্ডার। একটা ঘটনা ঘটার পর আমরা প্রাথমিকভাবে মোকাবেলা করি।”
গ্যাস সিলিন্ডার সংক্রান্ত দুর্ঘটনা রোধে সরকার ১৯৯১ সালে গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা করেছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া স্থানীয়ভাবে কাঁটাছেড়া করা সিলিন্ডার ব্যবহার অবৈধ।
গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা প্রতিপালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তবে এ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে গিয়ে গ্যাস বেলুন তদারকির মতো জনবল তাদের নেই। বিভিন্ন ধরনের সিলিন্ডার ও রাসায়নিকের অনুমোদন (লাইসেন্সিং) দিতেই তারা গলদঘর্ম।
এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক (যুগ্ম সচিব) মোহা. নায়েব আলী একই সংস্থায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত (উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক) আব্দুল হান্নানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
যোগাযোগ করা হলে আব্দুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্প্রতি একজন সাংবাদিক তথ্য জানতে এসে তার সঙ্গে ‘বাজে ব্যবহার’ করেছেন। তাই তিনি কোনো গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গেই কথা বলতে চান না।