‘এই আনন্দের জন্যই দশ বছরের কষ্ট’

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ সোমবার দেখা গেল ঢাকার স্কুলে স্কুলে।

মেহেরুন নাহার মেঘলামরিয়ম সুলতানা, নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2022, 03:00 PM
Updated : 28 Nov 2022, 03:00 PM

ফামিয়া মকবুল যখন নবম শ্রেণিতে উঠল, তার তিন মাসের মাথায় স্কুল বন্ধ হয়ে গেল মহামারীর কারণে। আর স্কুল যখন খুললো, তখন দশম শ্রেণির ধাপ শেষ প্রায়। 

তারও এক বছরের বেশি সময় পর মাকে জড়িয়ে ধরে এসএসসির ফল উদযাপনের সুযোগ হল তার। ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে এখন কলেজে পা রাখার স্বপ্নে বিভোর।

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার এই আনন্দ সোমবার দেখা গেল ঢাকার স্কুলে স্কুলে। তাদের সেই আনন্দে শামিল হলেন অভিভাবক আর শিক্ষকরাও।

বেইলি রোডে ভিকারুননিসার মূল ফটকের সামনে বেলা ১২টা থেকেই ছিল ফলাফল প্রত্যাশী শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের ভিড়। বেলা সাড়ে ১২টায় ফলাফল প্রকাশের পর বদলে যায় স্কুলের পরিবেশ।

স্কুলের মাঠে দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে আর ড্রাম বাজিয়ে চললো উদযাপন। কারও চোখে দেখা গেল আনন্দাশ্রু।

নাসরিন আক্তার নামের এক অভিভাবক বললেন, “এত আনন্দের জন্যই দশ বছর আমাদের বাচ্চারা কষ্ট করেছে। নানা প্রতিকূলতায় আমাদের মেয়েরা তাদের সাফল্যে পৌঁছেছে। বাচ্চারা রেজাল্ট ভালো করলে আমরা বাবা মায়েরাই বেশি খুশি হই।” 

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ৯৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। 

বন্যার কারণে এবার এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় মনযোগে বিঘ্ন ঘটেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে খুশি ফামিয়া। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বললো, “আমার প্রস্তুতি খুবই ভালো ছিল। কিন্তু পরীক্ষার মধ্যে বারবার সময় পরিবর্তন করার কারণে কিছুটা মনোযোগ হারাচ্ছিলাম। তার উপর এক পড়া বারবার পড়তেও ভালো লাগে না।

“যেখানে ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়ে এখন আমাদের কলেজে থাকার কথা ছিল, এখানে আমাদের অনেকটা গ্যাপ হয়ে গিয়েছে। তবুও আমার এই রেজাল্ট সেই গ্যাপটা পূরণ করে দিয়েছে।”

ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ফামিয়ার পাশেই ছিলেন তার মা সেহেলি হোসেইন। সন্তানের ফলাফলে তার চোখেমুখে ছিল সন্তুষ্টির ছাপ।

সেহেলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও বায়োলজি বিষয়টা নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। এই সাব্জেক্টে রেজাল্ট সবসময় ভালো করেছে। এখান থেকে ওর মনে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সে ডাক্তার হতে চায়। আশা করি আমার মেয়ের এই স্বপ্নটা পূরণ হোক। আজকে আমার অনেক খুশির দিন। আমরা যা প্রত্যাশা করেছি, ফলাফলও তেমনই হয়েছে।”

সোমবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে স্কুলের ফলাফল তুলে ধরেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ কামরুন নাহার। 

তিনি জানান, ২ হাজার ৩০৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে এবার পাস করেছে ২ হাজার ৩০১ জন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ২৫ জনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। ফেল করেছে পাঁচজন। 

অধ্যক্ষ কামরুন্নাহার বলেন, “করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক জটিলতায় ভুগলেও তারা আমাদের প্রত্যাশিত ফল এনে দিয়েছে। পাসের হার আগেরবারের চেয়ে বেড়েছে। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, এবার পেয়েছে ৮৮ শতাংশ।” 

ঢাকার নামি এ স্কুলের অধ্যক্ষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা লেখাপড়ার পাশাপাশি সবসময় মেয়েদের কো কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। একটা স্টুডেন্টকে পড়াশোনার জন্য বেশি চাপ দেওয়া মোটেই উচিত না। আমাদের মেয়েরা নিজেদের তাগিদ থেকেই ভালো ফলাফলের জন্য পড়াশোনা করে। 

“আর স্কুলের শিক্ষকরাও তাদের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল। আমি অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ করব, যারা কোনো কারণে আশানুরূপ ফলাফল লাভ করেনি, তাদের কোনোরকম চাপ দেবেন না, শিক্ষার্থীরা যাতে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেদিকে অভিভাবকরা যেন নজর দেন।” 

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “কয়েকজন অকৃতকার্য হলেও আমরা এটাকে ব্যর্থতা মনে করছি না। মেয়েদের নানা প্রতিকূলতা থাকে। আশাহত হওয়া যাবে না। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমি সত্যিই গর্ববোধ করছি।” 

এ স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা মম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বললো, “করোনার সময় যে ধাক্কা গিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের স্কুলগুলো অনেক সহযোগিতা করেছে। আমরা অনলাইনে অনেক পড়াশোনা করেছি। বেশ কয়েকটা মডেল টেস্ট দিয়েছি। আমাদের শিক্ষকরা সবসময় আমাদের গাইড করেছেন। এ কারণেই রেজাল্ট এত ভালো হয়েছে।” 

তবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের পরিবর্তে সম্পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা দিতে হলে ফলাফল এতটা ভালো নাও হতে পারত বলে মনে করছে মম। 

“আমরা তো পড়াশোনার জন্য সময় পাইনি। ক্লাস নাইনের একবছর ক্লাসই করতে পারিনি করোনাভাইরাসের কারণে। সেজন্যই সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের সিলেবাস শর্ট করা হয়েছে।” 

ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে সাফল্য পাওয়া আরেক শিক্ষার্থী তাসফিয়া হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললো, তার অনুভূতি ‘ভাষায় প্রকাশ করার মত না’। 

ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখা এই কিশোরী বললো, “যেরকম পরীক্ষা দিয়েছি, সেরকম ফলাফল পেয়েছি। এটা সত্যি আনন্দের।” 

বেইলি রোড এলাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও দেখা গেল শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছেন আনন্দ উৎসবে। 

এ স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাসনিম শরীফ। সে বললো, “আমরা করোনার মধ্যে স্কুলে আসতে পারিনি। স্কুলে এলেই আমাদের পড়াশোনাটা বেশি ভালো হয়, তার মধ্যে আবার বন্যার কারণে পরীক্ষার সময়সূচিতে পরিবর্তন এসেছিল। ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অনেকটাই জটিল ছিল। 

“তবুও এর মধ্য দিয়েই আমরা কষ্ট করেছি, আমাদের পরিবার, আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের পাশে ছিলেন। তারা আমাদের অবস্থাটা বুঝেছেন, কোনো ধরনের চাপ দেননি।” 

সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার ১৯৯ জন এসএসসি দিয়ে ১৯৬ জন পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের ১০৮ জন। 

ফার্মগেইট এলাকার আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। তবে শিক্ষকরা বেশ উৎসুক। 

অধ্যক্ষ মো. আব্দুল জলিল বললেন, তাদের স্কুল থেকে এবারই প্রথম এসএসসি দিল শিক্ষার্থীরা। পাসের হার ১০০%।  

“আমাদের এখান থেকে ১১ জন পরীক্ষা দিয়েছে। আনন্দের ব্যাপার হল, সবাই পাস করেছে। কিন্তু প্রথমবার তো, তাই এবার কোনো জিপিএ-৫ আসে নাই। আগামীবার থেকে অবশ্যই আসবে।” 

তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার ২৫২ জন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ২৪৯ জন পাস করেছে। জিপিএ পাঁচ পেয়েছে মোট ১৫১ জন। 

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহারের দাবি, জিপিএ পাঁচ পাওয়াদের সংখ্যা আরও বাড়ত, পাসের হারও শতভাগ হত, যদি দুই দফায় পরীক্ষার তারিখ পেছানো না হত।
“করোনার জন্য পরীক্ষাটা পেছাল। এ কারণে টেনশনে ছিলাম আমরা। আর এরপর বন্যার জন্য আরেকবার পেছাল। অবশ্য তাতে ঢাকার স্কুলগুলোতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু এই সময়টায় শিক্ষার্থীদের তো একটা মানসিক টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আর নাইনে তো ক্লাসই হয়নি ওদের।”  

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতিচারণ করে নুরুন্নাহার বলেন, “একটা সময় ছিল, যখন রেজাল্টের দিন মানেই ব্যান্ড পার্টি, শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের ভিড়। তখন রেজাল্ট আনতে আমরা বোর্ডে লোক পাঠাতাম। রেজাল্ট এলে পরে তা আবার আমরা এনভেলপে করে হাতে হাতে দিতাম। সে এক অন্যরকম দিন ছিল। এই দিনটা মানেই মুখরিত ক্যাম্পাস। 

“এখন আর তা হয় না, কারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের আগেই ঘরে বসে রেজাল্ট জেনে যায়। এখন যে মেয়েটা বাসায় বসেই রেজাল্ট হাতে পেয়ে যায়, সে আবার কষ্ট করে স্কুলে আসবে কেন! তাই গত কয়েকবছর ধরেই, মানে যখন থেকে অনলাইনে রেজাল্ট জানা যায়, তখন থেকে আর ওরা সেভাবে আসে না।” 

হলিক্রস কলেজ প্রাঙ্গণে অবশ্য বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে পাওয়া গেল। এই কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ পাঁচ পেয়েছে নওশিন নাওয়ার অরিন। বাসায় বসেই ইন্টারনেটে সে রেজাল্ট জেনে গেছে। তারপর মা আর বাবাকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে এসেছে বন্ধু আর শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে। 

অরিন বললো, পরীক্ষা নিয়ে তার আলাদা করে দুশ্চিন্তা ছিল না, ফল যে ভালো হবে, সে টা সে ‘জানতো’। 

এ কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সুগন্ধা সোম তার মা নিরুপমা মণ্ডলের সঙ্গে কলেজে এসেছিল। সুগন্ধার মাও বললেন, “ও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ওর ফলাফল নিয়ে আমাদের কারো তেমন কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ ও বলেছে যে ওর পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে।” 

তেজতুরি বাজারের বাসিন্দা বাসন্তী গোমেজে তার মেয়ে ভিক্টোরিয়া তুলি গোমেজকে নিয়ে হলিক্রসে এসেছেন। তুলি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ পাঁচ পেয়েছে। স্কুলে এসেছে সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে। 

হলিক্রস কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক শীমন্ত পিউস রড্রিক্স বললেন, “এত এত বাধার পর পরীক্ষাটা হল, তারপরও দেখা গেছে যে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের ফলাফল ভালো। কোনো ফেইল নাই। তবে পরীক্ষাটা যদি অন টাইমে হত, তাহলে ওদের জন্য আরও ভালো হত। বারবার তারিখ পেছানোয় ওরা মানসিকভাবে চাপের মাঝে ছিল।” 

এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবার পরীক্ষা দিয়েছে মোট ২৫৪ জন। তাদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২২৯ জন। গতবছর পরীক্ষার্থী ছিল ২৩৪ জন; জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২২০ জন। 

সারাদেশে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা গতবারের চেয়ে কম। জিপিএ ৫ পেয়েছে মোট ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন।