এদিন পুলিশসহ প্রথম দফায় গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
Published : 08 Feb 2025, 10:46 PM
পুলিশের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে জোর দিয়ে পৃথক পুলিশ কমিশন গঠনসহ বলপ্রয়োগ, আটক, গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে আমূল পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন।
একই সঙ্গে ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন এবং র্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে।
শনিবার প্রকাশ করা এ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিন পুলিশসহ প্রথম দফায় গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
এর আগে ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। ওই সময় প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছিল।
শনিবার ৩৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে।
জুলাই-অগাস্ট গণ অভ্যুত্থানে পুলিশ ও জনগণের সম্পর্কে সৃষ্ট গভীর ক্ষত নিরাময়ের লক্ষ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী এসব সুপারিশ করেছে।
কমিশন বলছে, এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে পুলিশ বাহিনী আরও জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক হয়ে উঠবে। পুলিশকে জনগণের কাছে আসতে সহযোগিতা করবে।
পুলিশের সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদী ও চলমান প্রক্রিয়া বলে তুলে ধরে কমিশন বলেছে, প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।
“এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও অঙ্গীকারের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশি সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”
কমিশন বলছে, মানবাধিকার সুরক্ষা, বলপ্রয়োগ নীতি, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সংস্কার, অযাচিত হয়রানির (আটক/গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদকেন্দ্রিক) অবসান, বিদ্যমান বিভিন্ন সেবার মানোন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, পুলিশের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং জনসম্পৃক্ত পুলিশিংয়ের প্রসারসহ ১৫টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। তিন দিন পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। পরে ৩ অক্টোবর সাবেক স্বরাস্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে ২ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমার কথা ছিল। পরে তাদের ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে দেওয়ার পর ১৫ জানুয়ারি কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।
পুলিশ সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষের মত নিয়েছিল কমিশনটি। সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেন।
শনিবার প্রকাশিত সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া 'কেমন পুলিশ চাই' শীর্ষক জনমত জরিপসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকেও পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব আসে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায়, পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে এ কমিশন নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। তবে বিবেচ্য কমিশনের গঠন-কাঠামো, কার্যাবলি ও পরিধি কেমন হবে, তা আরও বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা সমীচীন হবে।”
র্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ
পুলিশের এলিট ইউনিট হিসেবে গঠিত র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানি রোধেও সংস্কার কমিশন কিছু সুপারিশ করেছে। এজন্য ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন, তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিচয় দেওয়ার বাধ্যবাধকতা, থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামুলক করা, তদন্ত কাজের জন্য বিশেষ বরাদ্দ এবং ফৌজদারি মামলার জন্য বিশেষায়িত তদন্ত দল গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে পাঠানো আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ রাখতে হবে।
সংশোধন করতে হবে ফোজদারি কার্যবিধি
১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি এবং ১৯৫৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন্স (পিআরবি) সংশোধন বা হালনাগাদের সুপারিশও করেছে কমিশন।
এসব আইনে প্রমোজনীয় সংশোধন বা সম্পূর্ণ নতুন আইন ও প্রবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে পুলিশকে জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক ও মানবাধিকার সংরক্ষণে সক্ষম একটি বাহিনীতে পরিণত করার লক্ষ্যে এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দ্রুত তদন্তের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে মানবাধিকার সেল প্রতিষ্ঠা করা, ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং র্যাবের অতীতের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশের কথা বলা হয়েছে সংস্কার কমিশনের পুর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের মাধ্যমে গঠিত হত্যাকাণ্ড ও হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তি ও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে।
বলপ্রয়োগে পাঁচ ধাপের পরিকল্পনার বৈধতা দেওয়ার সুপারিশ
মান নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বলপ্রয়োগনীতির ক্ষেত্রে, বর্তমান সংস্কার কমিশন পাঁচ ধাপের একটি বলপ্রয়োগ পরিকল্পনাকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশন বলছে, এই পরিকল্পনা ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং ১৯৫৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলপ্রয়োগ নীতিমালার অনুসরণে করা হয়েছে।
এটি আধুনিক প্রযুক্তিগত কৌশল বিবেচনায় নিয়ে প্রণীত, যা ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে বলে মনে করছে কমিশন।
চাকরিপ্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের প্রস্তাব
হয়রানি কমাতে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাইয়ের প্রযোজনীয়তা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে হবে এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ ১ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
কমিশন পুলিশের দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বল্পমেমাদী উদ্যোগ হিসেবে ওয়াচডগ বা ওভারলাইট কমিটি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করেছে।
অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে
>> পুলিশের দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বল্পমেয়াদী কার্যক্রম হিসেবে ‘ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি’ গঠন
>> পুলিশের পুরস্কার প্রদানের বর্তমান কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন
>> নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতিতে সততা ও নিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়া
>> পুলিশের কল্যাণ ও কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য তাদের স্বাস্থ্যসম্মত ও মানবিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা
>> অতিরিক্ত কাজের চাপ কমাতে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা
>> ফিটলিস্ট হালনাগাদ করে পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়ন
>> কনস্টেবল ও এসআই পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং নিশ্চিত করা
>> বিভাগীয় পদোন্নতির নীতিমালা সংস্কার
>> তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে জরুরি যোগাযোগের জন্য নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু
>> মামলা নিয়ে হয়রানি কমাতে জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, কোনোভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করা যাবে না
>> মামলার এফআইআর গ্রহণে কোনো ধরনের অনীহা বা দেরি করা যাবে না
পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ চায় সংস্কার কমিশন
র্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নসহ পুলিশ সংস্কারে আরও যেসব সুপারিশ
৬ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ
'রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে পুলিশ সংস্কার স্থায়ী হবে না'