“১৯৭১ সালের পর থেকে দেশের রাজনীতিবিদরা পুলিশকে কখনও ‘স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়নি’। যারা রাজনীতিবিদ আছে, তারা চান না পুলিশ সংস্কার হোক। কাজেই আমাদের আগে ‘রাজনৈতিক রিফর্ম’ করা দরকার,” বলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি নেছার উদ্দিন।
Published : 18 Dec 2024, 06:34 PM
পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখা না গেলে এ বাহিনীর সংস্কার কার্যক্রম স্থায়ী হবে না বলে মতামত উঠে এসেছে চট্টগ্রামের এক আলোচনাসভায়।
বন্দর নগরীর একটি হোটেলে বুধবার ‘পুলিশ সংস্কার বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনায় এ বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, বেতনভাতা ও পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা অভিমত তুলে ধরেন।
সভায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) নেছার উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুলিশ জনগণের একটা অংশ। তারপরও আমরা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ পুলিশের সেবা না হলে চলে না।
১৯৭১ সালের পর থেকে দেশের রাজনীতিবিদরা পুলিশকে কখনও ‘স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়নি’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “২০০৭ সালে পুলিশ আইন সংস্কারের কথা উঠলেও হয়নি। কারণ যারা রাজনীতিবিদ আছে, তারা চান না পুলিশ সংস্কার হোক। কাজেই আমাদের আগে ‘রাজনৈতিক রিফর্ম’ করা দরকার।”
পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন নেছার উদ্দিন।
তার ভাষ্য, “আগে যারা স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে, তাদের নানা ধরনের অসুবিধা হয়েছে। তাদের পদোন্নতি হয়নি, চাকরিচ্যুত হয়েছে এবং নানা ধরনের লাঞ্চনার শিকার হয়েছিল।”
পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বাধীন করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশের বদলি, শাস্তি প্রক্রিয়া আলাদা করেন। তারপরে আসেন পুলিশের আচরণে। পুলিশকে নিজের মত কাজ করার সুযোগ দিলে ‘মানসিক সমস্যা’ হবে না। এসব বিষয়গুলো ঠিক করলে যে যোগ্য, সে বাহিনীতে থেকে যাবে। আর অযোগ্য হলে বের হয়ে যাবে। পুলিশ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে থাকার বিষয়টি আমরাও চাই।”
পুলিশকে জনবান্ধব করতে ১৮৬১ সালের আইন পাল্টানোর পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান।
তিনি বলেন, “ওই আইনে পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব না করে ক্ষমতায়ন করা হয়েছ, যা না পাল্টালে পুলিশকে জনবান্ধব করা সম্ভব নয়।”
পুলিশের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো গঠনের মতামত দিয়ে তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন পেশার লোকজন তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে আন্দোলনে নামলেও পুলিশকে কখনও বেতন ভাতা নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায়নি।
অধ্যাপক নোমানের মতে, পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে সেই আস্থা ফেরানো যাবে না। পুলিশের মধ্যেও বৈষম্যের কথা বলেছেন তিনি।
“পুলিশের মধ্যে কয়েকটা ধাপ আছে। কনস্টেবলদের ২৪ ঘণ্টা ডিউটিতে থাকতে হয়। কিন্তু তাদের আবাসন ব্যবস্থা খুবই কষ্টকর। এ বৈষম্যকে দূর করতে হবে। এটা দূর করা না গেলে সেবা দানের মানসিকতা পাল্টানো যাবে না।”
পুলিশ সংস্কারের জন্য প্রথমে থানা সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শাহজালাল মিশুক।
তিনি বলেন, “সব মানুষ সব জায়গায় যেতে চাইলেও পুলিশের আচরণগত কারণে থানায় যেতে চান না। সেজন্য সিভিল সোসাইটির মাধ্যমে সেগুলোর তদারকির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।”
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আমীর মুহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে। সেটা ঠিক করতে না পারলে কোনোভাবেই পুলিশ সংস্কার সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের কারণে পুলিশ কন্ট্রোল হয়ে যায়। অন্যথায় তারা নিয়ন্ত্রিত থাকার কথা না।
“বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কার হচ্ছে। কিন্তু যারা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আগে তাদের সংস্কার দরকার। আমরা নিজেদের সংস্কার না করলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো কখনও স্থায়ী হবে না।”
ইউএনডিপির সহায়তায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা এই আয়োজনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) শাকিলা সোলতানা, চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাদিকা সুলতানা চৌধুরী, ইপসার পরিচালক (অর্থ) পলাশ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রমিক নেতা তপন দত্ত, সাংবাদিক জসীম উদ্দিন চৌধুরী সবুজ, কবি ওমর কায়সার, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রিদুয়ান সিদ্দিকী, নীলা আফরোজ, আরিফ মঈনুদ্দীন, তাওহীদ আলিফ সভায় বক্তব্য দেন।
মতবিনিময় সভার প্রস্তাবগুলো লিখিত আকারে পুলিশ সংস্কার কমিশনের পাঠানোর কথাও বলেছেন আয়োজকরা।