বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ স্মরণ

মেলায় ভাঙনের সুর, পর্দা নামছে মঙ্গলবার।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2023, 05:18 PM
Updated : 27 Feb 2023, 05:18 PM

পাইরেসিমুক্ত বইমেলার দাবি জানিয়ে বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ করা হল একুশে বইমেলায়। 

সোমবার বিকালে বইমেলার তথ্যকেন্দ্রের সামনে মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করে লেখক প্রকাশক পাঠক ফোরাম। 

এতে অংশ নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “সারা জীবন যিনি সমাজকে সুন্দর করার জন্য কাজ করেছেন, তাকে মৌলবাদীরা খুন করেছে। হুমায়ুন আজাদ হত্যার বিচারের দাবি জানাই। এই বিচার সম্পন্ন করে সারা পৃথিবীতে জানিয়ে দিতে হবে, এই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের স্থান নাই।" 

যে জায়গাটিতে হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই জায়গাটিকে ‘আইকনিকভাবে’ সংরক্ষণ করার আহবান জানান তিনি। 

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল তার বক্তব্যে হুমায়ুন আজাদের নামে বার্ষিক পুরস্কার প্রবর্তনে বাংলা একাডেমির প্রতি আহ্বান জানান। আর বইমেলায় হুমায়ুন আজাদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান তার ছোট ভাই সাজ্জাদ কবীর। 

এই প্রস্তাবে সংহতি জানিয়ে মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেন, "হুমায়ুন আজাদের স্মৃতিকে বইমেলায় কিভাবে জাগিয়ে রাখা যায়, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং বাংলা একাডেমি থেকে পুরস্কার প্রবর্তনের ব্যাপারেও যথাযথ প্রক্রিয়া উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

“বাংলা একাডেমি থেকে কিছু করতে গেলে কিছু প্রক্রিয়াগত ব্যাপার আছে। আমি মহাপরিচালক হিসেবে প্রস্তাবগুলো নিয়ে যথাযথ জায়গায় কথা বলে ব্যবস্থা নেব।" 

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, "মুক্তচিন্তার পক্ষে, প্রগতির পক্ষে হুমায়ুন আজাদ দাঁড়িয়েছেন। ধর্মের নামে ব্যবসা করা হলো প্রতিক্রিশীলতা। হুমায়ুন আজাদ এসব প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে ছিলেন। হুমায়ুন আজাদের অপরাধ ছিল, তিনি প্রগতির পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তচিন্তার পক্ষে ছিলেন- এটাই তার অপরাধ। 

“তিনি জীবন দিয়ে মুক্তচিন্তার পক্ষে পথরেখা তৈরি করে গেছেন। আমাদের এই পথ ধরেই হাঁটতে হবে।" 

ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, "এই দিনটি স্মরণ করে ছাত্রলীগ থেকে আমরা প্রতি বছর আলোর মিছিল করি। এর মধ্য দিয়ে তরুণদের মাঝে প্রগতিশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই।

“বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব- হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ করে আরও কিছু পরিকল্পনা যেন করা হয়। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও অনুরোধ করি হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ করে যেন পরিকল্পনা করা হয়।" 

হুমায়ুন আজাদকে কারা খুন করেছে, তাদের কারা প্রশ্রয় দেয়- প্রশ্ন রেখে সাদ্দাম বলেন, “আমরা তাদের চিনি, এই অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। তারা মুক্তবুদ্ধিকে থামিয়ে দিতে চায়। তারা প্রভাত ফেরিতে ফুল দেওয়া নিয়ে সমালোচনা করে। তারা এই দেশকে পাকিস্তান বানায়ে চায়। এমরা সেটা হতে দেব না।" 

কবি মোহন রায়হান বলেন, “হুমায়ুন আজাদকে কারা খুন করেছে? তারা খুন করেছে, যারা বাংলাদেশকে খুন করতে চায়। হুমায়ুন আজাদ স্যার মুক্তচিন্তার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ স্যার যে আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, সেই আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হবে।" 

ওসমান গণি হলেন, "আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। এজন্যই নতুন প্রজন্মের কাছে হুমায়ুন আজাদ যেন বিস্মৃত না হন, তার জন্যই তাকে স্মরণ করে প্রতি বছর এই স্মরণানুষ্ঠান আয়োজন করি।" 

মেলায় ভাঙনের সুর 

সোমবার ছিল বইমেলার ২৭তম দিন। মেলা চলে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এ দিন নতুন বই এসেছে ১৫৮টি। 

মেলায় এ দিন বিভিন্ন স্টলে অনেককেই তালিকা হাতে নিয়ে বই কিনতে দেখা যায়। রাজশাহী থেকে আসা শিশুসাহিত্যিক মাসুম আওয়াল বললেন, "পছন্দের কিছু বই কিনেছি, শেষদিন আরও কয়েকটি বই কিনব।" 

এই লেখকের গোয়েন্দা কাহিনীর বই 'ডব্লিউ হিং টিং ছট' মেলায় প্রকাশ হয়েছে। মাসুম আওয়াল বলেন, "বইটি মেলায় গত সপ্তাহে এসেছে, ভালো বিক্রি হচ্ছে।" 

মেলার বিভিন্ন স্টলের বিক্রয় কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, শেষ মুহর্তের চাপ সামাল দিতে যেমন ক্লান্তি এসেছে, তেমনই উৎসব ভাঙার জন্য মন খারাপও। 

প্রথমা প্যাভিলিয়নে কাজ করছেন আনিকা। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বইমেলায় এবারই প্রথম স্টলে কাজ করেছি। টানা এক মাস কাজ করে ক্লান্ত লাগছে। আবার মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মন খারাপও লাগছে।" 

মেলায় এ দিন অনেকের হাতেই দেখা যায় বইয়ের প্যাকেট। আবার কেউ ব্যস্ত আড্ডায়। নাট্যশিল্পী সাইফুল জার্নাল ও আজমাইন আজাদ কথা এসেছিল তাদের ১১ মাসের সন্তান হীরামণকে নিয়ে। ছোট্ট হীরামণকে পেয়ে অনেকেই কোলে নিয়ে আদর করতে থাকেন। কেউ কেউ হীরামণের সাথে ছবিও তোলেন। 

আজমাইন আজাদ বলেন, "কয়েকটি বই কিনেছি। আর হীরামণকে নিয়ে এসেছি। এটাই প্রথম বইমেলায় আসা।" 

নানা অনুষ্ঠান 

বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববাঙালির সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আলম খোরশেদ। আলোচনায় অংশ নেন এ এফ এম হায়াতুল্লাহ, আ-আল মামুন ও জসিম মল্লিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।  

এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন জাহিদ মুস্তাফা, মুমিত আল রশিদ, ফরিদ আহমদ দুলাল, আরেফিন রব।

সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন রোকেয়া ইসলাম, শেখর বরণ, সৌম্য সালেক, খসরু পারভেজ, সুবর্ণ আদিত্য, জান্নাতুল ফেরদৌসী এবং থিউফিল নকরেক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন সাইমুন আনজুম ইভান, সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ, অনন্যা রেজওয়ানা ও ফারহানা তৃর্ণা। এছাড়া ছিল মিলন কান্তি দের রচনা ও নির্দেশনায় দেশ অপেরা যাত্রাপালার পরিবেশনা ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে’। 

সংগীত পরিবেশন করেন ডা. রেজাউর রহমান, মো. আলী হোসাইন, মীর তারিকুল ইসলাম, পল্লবী সরকার মালতী, ঝরনা রায় ভাবনা, মুন্নি কাদের, আঁখি আলম, আরিফ বাউল, কামাল আহমেদ, মো. আরিফুর রহমান চৌধুরী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), ডালিম কুমার বড়–য়া (কি-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি) এবং মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড)। 

মেলার পর্দা নামছে মঙ্গলবার 

মঙ্গলবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলা ও অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিন। মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। 

প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’ এর সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। 

অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হবে। এছাড়া সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে সমাপনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার 

অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হবে। 

২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত বিচ্ছিন্ন ভাবনা প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি বইয়ের জন্য ঐতিহ্য এবং হাবিবুর রহমান রচিত ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ দেওয়া হবে। 

২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খি’কে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ দেওয়া হবে।

২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট) ও উড়কি’কে (১ ইউনিট) শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ দেওয়া হবে।