“আগে মধ্যবিত্তদেরও খাবারের যে বৈচিত্র ছিল, এখন সেটা পারছে না। ফলে প্রতিদিন যে পুষ্টির দরকার সেগুলো এফোর্ট এখন করতে পারছে না। সেগুলোর প্রভাব আমরা সামনে দেখতে পাব; পুষ্টিহীনতা বাড়বে।”
Published : 24 Jan 2025, 01:21 AM
দুর্মূল্যের বাজারে কাজ না থাকায় এক সপ্তাহ ধরে ‘লবণভাত’ খেতে হচ্ছে; খাবারের এমন কষ্টে আর কখনও পড়েছেন কি না মনে করতে পারেন না কালশী বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দা জুবাইদা বেগম।
মধ্যবয়সী এই নারী একা থাকলেও খাওয়ার কাজটি সারেন ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে। সেখানে তিনি, ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাইঝি মিল ঠোঙা তৈরি করেন। সব মিলিয়ে পরিবারটি মাসে সর্বোচ্চ আয় করতে পারে ১৫ হাজার টাকা। তবে দেড় সপ্তাহ ধরে ঠোঙা বানানোর কাজ বন্ধ থাকায় খাবারের জোগাড় নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে এই পরিবারকে।
মাসে তাদের বাসা ভাড়ার পেছনে গুনতে হয় ৪ হাজার টাকা। বাকি ১১ হাজার টাকার পুরোটা যদি খাবারের খরচ হিসেবে ধরা হয়, তাহলে মাথাপিছু দিনে পড়ে ৭০ টাকা।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দৈনিক একজনের স্বাস্থ্যকর খাবারের খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৬৪ ডলার অর্থাৎ ৪৪৩ টাকা ৫৭ পয়সা; যা কেনার সামর্থ্য নেই দেশের ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ বা ৮ কোটি ২৪ লাখ মানুষের।
জুবাইদা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ভাইও প্রতিদিন কাজ পান না; ফলে দুইদিন কাজ বন্ধ থাকলেই চুলা বন্ধ হয়ে যায়। পুরোদিন না খেয়েই থাকতে হয়।
“এখন লবণ ভাত খায়ে ক্ষিধা মিটাইতেছি। কুরবানির পর আর গরুর মাংস খাইতে পারি নাই। কাজ থাকলে সপ্তাহে একবার ডিম খাই, তাও অর্ধেক। সপ্তাহে দুই/তিনবার ছোট মাছ, মাঝমধ্যে মুরগী খাই। ফল কিনার কথা ভাবিও না আমরা।”
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা অবনমনের তথ্য উঠে এসেছে কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের প্রতিবেদনে। অক্টোবরে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন ধাপ অবনমন হয়ে এবার ১২৭টি দেশের মধ্যে ৮৪তম অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ।
আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টির শিকার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অপুষ্টির কারণে থমকে গেছে। এর মধ্যে ২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু তাদের পঞ্চম জন্মদিনে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়।
মিরপুর-১২ নম্বর এলাকার গৃহকর্মী সুরমা বেগম ও তার ছেলে মাসে আয় করেন ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাসা ভাড়ায় ৮ হাজার আর দুই ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার জন্য ৩ হাজার টাকা খরচ করতে হয় তার। বাকি ৯ হাজার টাকা দিয়ে ৬ সদস্যের পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে হয় সুরমাকে। অর্থাৎ দিনে খাবারের জন্য জনপ্রতি তারা ৫০ টাকা খরচ করতে পারছে।
সুরমা বলেন, “তরকারির দাম একটু কমলেও চাইল, তেলের দাম তো বাড়তিই। এখন দাম কমের কারণে সবজি কিনি। নাইলে শাক, ডাল দিয়াই খাই। মাঝেমইদ্যে মাছ কিনি, মাংস অনেক কম খাওয়া হয়। কোলের বাচ্চাটারেও দুধ কিনা দিতে পারি না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীনের মতে, খাবারের উচ্চমূল্য, মহামারীর পর মানুষের কর্মহীনতা, বৈশ্বিকভাবে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আগের চেয়ে খাবার কেনার সক্ষমতা কমেছে। এতে পুষ্টির ঘাটতি বাড়ছে, ফলে এ পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “যে খাবারগুলোর দাম বেশি, সেগুলো তারা কেনে না। যেগুলো কিনতে পারে, সেগুলো দিয়ে কোনোরকমে খায়। সবমিলিয়ে যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, তারা বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসছে বা আরও লাইনের নিচে পড়ে গেছে।
“আগে মধ্যবিত্তেরও খাবারের যে বৈচিত্র্য ছিল, এখন সেটা পারছে না। যার ফলে তার প্রতিদিনের যে পুষ্টির দরকার, সেগুলো এফোর্ট এখন করতে পারছে না। সেগুলোর প্রভাব আমরা সামনে দেখতে পাব; পুষ্টিহীনতা বাড়বে।”
কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টির সচেতনতা বাড়াতে কাজ করা সংগঠন বিআইআইডি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন আকবর বলেন, মহামারীর পর জিনিসপত্রের দাম বাড়ার ফলে স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে এ পরিস্থিতির আরও বেশি অবনতি হওয়ার কথা বলছেন তিনি।
“এভাবে পুষ্টির চাহিদা পুরণ হওয়ার সুযোগ নেই। ছয়টি ফুড গ্রুপ (শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, পানি ও চর্বি) অনুযায়ী খাবারটা খেতে হবে। কোনোটা কম-বেশি হলে বিভিন্ন রকমের সমস্যা হয়। ১৮ বছরের আগে গর্ভবতী হলে তাদের বাচ্চারাও কম ওজনের হয়। কিশোরী মেয়েদের মধ্যে পুষ্টির ঘাটতির পরিমাণটা বেশি দেখা যায়।”
নিউট্রেশন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সাইকা সিরাজের ভাষ্য, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনার সক্ষমতা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে পুষ্টিহীন লোকের সংখ্যা আরও বাড়বে।
মধ্যবিত্তের হাড়িতেও টান
মিরপুর ১২ নম্বরে স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আশরাফ হোসেন। তার বেতনের ৩৫ হাজার টাকা থেকে বাসা ভাড়াতেই চলে যায় ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া নিজের ও পরিবারের কিছু বাড়তি খরচ আর গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানোর পর ভালো কিছু কেনার সাহসই করতে পারেন না তিনি।
“আগে কয়েক পদের তরকারি, প্রতিদিন একটা করে ডিম, ডাল, মাছ খাওয়ার চেষ্টা করতাম। এখন খুব কম ডিম কেনা হয়, ফল কিনি না দুই মাস হবে। সবজির দাম কমছে, মাঝেমধ্যে মাছ কিনি এভাবেই চলতেছি। ধারও জমে গেছে অনেক।”
নাখালপাড়ার বাসিন্দা আমিনুর রহমান ও তার স্ত্রী মিলে মাসে আয় করেন ৫০ হাজার টাকা। তাদের বাসা ভাড়া আর দুই সন্তানের স্কুলের খরচ যোগাতে মাসে ব্যয় করতে হয় ২৫ হাজার টাকা।
আমিনুর বলেন, বর্তমানে তাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে এসেছে; ভরপেট খাওয়াটা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
“দাম সহনীয় থাকলে মাছ, ডিম, মুরগি, সবজি, ডাল সব মিলিয়ে খাই। যদিও সবজি আর ডালটা বেশি খাওয়া হয়। মাঝখানে দাম বাড়ল না, তখন এক/দুই পদের তরকারি দিয়েই খেতে হয়েছে। মাছ, মাংস তখন খুব কম খেয়েছি। এখনওতো বাজার খুব একটা নিয়ন্ত্রণে নেই। জিনিসের দাম বাড়ে, আমাদের আয় তো বাড়ে না।”
দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২১-২৩ সালে মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৩ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এই সময়ে দেশে মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ আর মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৫ কোটি ২৩ লাখ জনগোষ্ঠী।
তবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ২০ শতাংশ বা ১ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। আর ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ৩১ শতাংশ শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার।
ডব্লিউএফপির ৯ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অগাস্টের বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় ৩৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
দাম বাড়ার কারণে ৩০ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে এবং ৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া ২৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ কমিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
সংস্থাটি তাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকার কথা বলছিল। সেখানে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ সঙ্কুচিত হওয়া এবং চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে আগের বছরের তুলনায় এ অবস্থার অবনতি হয়।
বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও পুষ্টি নীতি ২০২০ এ বলা হয়েছিল, জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ সুষম খাবারের ঘাটতিতে রয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবসান (এসডিজি-১), ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন (এসডিজি-২) করতে চায় সরকার।
২০২২ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ‘নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক পারিবারিক নির্দেশনায়’ বলা হয়েছে, দেশের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম শিশু খর্বকায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশু ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য খাবার এবং প্রায় ৫৬ শতাংশ নারী অপর্যাপ্ত খাবার গ্রহণ করছে। প্রায় ৫০ শতাংশ প্রজনন বয়সী নারী বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে, যার প্রভাবে কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম হচ্ছে।
এর প্রভাবে দেশের ৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস মেলিটাস, ১৮ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপ এবং ১৭ শতাংশ মানুষ হৃদরোগের শিকার।
এতে বলা হয়, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২৭০-৪২০ গ্রাম পরিমাণ চাল বা গম, শ্বেতসার বিশিষ্ট মূল, কন্দ এবং কলা ৭৫-১০০ গ্রাম, মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরো মাছ/ মাংস এবং ১ থেকে ২ কাপ ডাল জাতীয় খাবার, অন্তত ১ কাপ দুধ বা দুধজাতীয় খাবার, অন্তত ২টি মৌসুমি ফল, অন্তত ১০০ গ্রাম বা শাক ২০০ গ্রাম সবজি এবং ১টি ডিম খাওয়া উচিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ ছিল।
অর্থাৎ, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১০ টাকা ৮৯ পয়সা। আর খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২১০০ কিলোক্যালরি) নিতে হয়, তাতে প্রতি মাসে খরচ হওয়ার কথা ১৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটাকেই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
ডব্লিউএফপির গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক হিসাব বলছে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার নিতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু খরচ করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার নিতে একজন মানুষের খরচ হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
সরকারি পরিসংখ্যানে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি না বাড়ায় গত দুই বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক।
ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) ১৫ ডিসেম্বর এক কর্মশালায় সহযোগী অধ্যাপক মো. দীন ইসলাম এই তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “দুই বছরে ৭৮ লাখ ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে সহনীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। একই সঙ্গে ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। এ সময়ে নতুন করে ৩৮ লাখ মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্রতে নেমে এসেছে।”
তবে এই গবেষণা করতে মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপ করা হয়নি, মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির গড় হার বিবেচনায় এই হিসাব করা হয়েছে। গবেষণার এ প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্য সীমা এবং অতি দারিদ্র্য সীমার ক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতাকে বেছে নিয়েছে।
সরকারের দেওয়া বিবিএসের তথ্যেই মূল্যস্ফীতি এবং প্রকৃত মজুরির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ৬ শতাংশের বেশি মানুষ তাদের ক্রয় ক্ষমতা ‘হারিয়েছে’। এর ফলে তারা নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে।
পুষ্টিহীনতায় কী সমস্যা হচ্ছে?
জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, পুষ্টিহীন শিশুদের বয়স অনুযায়ী উচ্চতা বাড়ে না, ওজন কম হয়, বড়দের ক্ষেত্রে পাতলা চুল, চুল পরে যাওয়া, রুক্ষ চেহারা, দেখতে অসুবিধা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দুর্বলতা, অসুখে বেশি আক্রান্ত হওয়া এবং সংক্রমণ বেশি হয়।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদন বলছে, অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থাৎ বয়সের অনুপাতে তাদের উচ্চতা বাড়ছে না। উপরন্তু পাঁচ বছরের কম বয়সী ১১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ উচ্চতার অনুপাতে তাদের ওজন বাড়ছে না।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট), স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ‘ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০২২’ অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী ২৪ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্থবির, ২২ শতাংশ শিশু কম ওজনের এবং ১১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ নষ্ট ছিল।
অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “পুষ্টির ঘাটতি হলে বাচ্চাদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম হয়, ওজন কম হয়, কৃশকায় বাচ্চা হয়, তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিকশিত হয় না। যেসব নারীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তারা তো একটা সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে না। এসব বাচ্চাদেরকে জন্মানোর পর বেশি পুষ্টি দিলে তারা ওভারওয়েট, স্থুল হবে।”
বিআইআইডি ফাউন্ডেশনের শহীদ উদ্দিন আকবর বলেন, “অসংক্রামক ব্যাধি- হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, ব্লাড প্রেশার বাড়ছে, ক্যান্সার বেশি হচ্ছে; এগুলোর বড় কারণ ম্যালনিউট্রেশন। পুষ্টিহীন হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, শারীরিকভাবে কম শক্তিশালী হয়। পরবর্তীতে যখন সে বড় হতে থাকে তার স্কিল বাড়ে না। রোগবালাই বেশি হবে, দ্রুত অসুস্থ হয়ে যাবে, কিডনির, হার্টের, ফুসফুসের সমস্যা হবে।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, পুষ্টির ঘাটতি থাকলে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়; যার প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতে পরে।
“পুষ্টিহীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য যদি বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা তাকে উৎপাদন সক্ষম রাখবে। অর্থাৎ এর জন্য ১০ টাকা বিনিয়োগ করা হলে ১২ টাকা হলেও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে তার।”
করণীয় কী?
পুষ্টির ঘাটতি দূর করতে খাবারের প্রাপ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি জাতীয়ভাবে সচেতনতার তাগিদ দিয়েছেন শহীদ উদ্দিন আকবর।
তিনি বলেন, “পুষ্টি যে জরুরি সেটা সবাইকে বোঝাতে হবে। যার কেনার সক্ষমতা নেই তাকে সহায়তা করতে হবে, টিসিবির ট্রাকে পুষ্টিকর খাবার অ্যাড হচ্ছে কি না নিশ্চিত করতে হবে, স্কুল মিল চালু করা যেতে পারে।
“পাশাপাশি নিরাপদ খাবারটাও জরুরি। যেমন, মুরগি বেশি ফ্রাই করে ফেললে সেটাতে আর পুষ্টি থাকে না। শাক কাটার আগে ধুতে হবে, কাটার পর ধুলে পানির সঙ্গে পুষ্টি চলে যায়। লবণ রান্নার শেষের দিকে যোগ করতে হবে। তেল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে না।”
আর পুষ্টি পরিষদ বলছে, পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে মাছ, মাংসের বিকল্প হিসেবে- সয়াবিন, পেয়ারা, কলা, সবজি, ডাল, ছোট মাছ এগুলো খেতে হবে। তবে প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে হবে।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, পুষ্টিহীনতার ধরনের ওপর নির্ভর করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারাদেশে পুষ্টি কর্মর্সূচির আওতায় তাদের আদর্শ খাবার দেওয়া হয়।
“খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না; এর ফলে পুষ্টিহীনতা তৈরি হতে পারে সেগুলো এখনো অ্যাড্রেস করা শুরু হয়নি। পুষ্টিহীনতা থামানোর জন্য তাদের ভালো খাবার দিতে হবে, খাদ্য, অর্থ, বাণিজ্য এসব মন্ত্রণালয় দেখবে এটা।”
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, “মূল বাজারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছি না আমরা। কারণ শক্তিশালী সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি আছে। আমরা ভাবছি সরাসরি খামারিদের থেকে ভোক্তা পর্যায়ে খাবার নিয়ে আসতে, সব জায়গা থেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সরানোর চেষ্টা চলছে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে।”